অনীশ বলল, তারা তো গ্রামের লোক নয় বলেই জানি।
নরবু বলল, তারা গ্রামের লোক নয় ঠিকই কিন্তু একবার নেকড়েরা মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষ মারতে শুরু করে। আমাদের দুজন লোককে নেকড়েগুলো তাড়াও করেছিল। পালিয়ে এসেছে তারা। এই জঙ্গলের ওপরই আমাদের জীবন নির্ভর করে। কাঠ সংগ্রহ, পশুপালন সব বন্ধ হতে বসেছে।
অনীশ বলল, সে তো অন্য নেকড়েও করতে পারে। নেকড়ের তো অভাব নেই এখানে?
নরবু বলল, কথাটা ঠিক। কিন্তু মানুষগুলোকে মেরেছে খামারের নেকড়েগুলোই। আমাদের লোক দুজনকে ওরা তাড়া করার পর যখন আমরা নেকড়ে মারার জন্য জঙ্গলে ঢুকি তখন ওই খামারের দুজন লোককে পেয়েছিলাম জঙ্গলের ভিতর।
অনীশ বলল, তাদেরও তো তোমাদেরই মতো জঙ্গলে ঢুকতে বাধা নেই। তোমরা কি নেকড়ে পেয়েছিলে তাদের সঙ্গে?
বৃদ্ধ জবাব দিল, না, পাইনি।
অনীশ বলল, তবে কীভাবে প্রমাণ হল যে খামারের নেকড়েরাই মানুষ মারছে?
প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃদ্ধ বলে উঠল, দুটো নেকড়ে তাড়া করেছিল আমাদের লোকদের। বনের ভিতরও পাওয়া গেছিল খামারের দুজনকে। আসলে ওরাই তাড়া করেছিল আমাদের লোকদের। ওরা আসলে মানুষ নয়, নেকড়ে মানুষ।
নেকড়ে মানুষ! ওয়্যার উল! মৃদু চমকে উঠল অনীশ। এদের আতঙ্কের আসল কারণটা এবার বুঝতে পারল সে। বহু দেশের পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে কু-সংস্কার আছে যে যুদ্ধে যারা মারা যায় তারা নেকড়ে হয়ে যায়। বিশেষত দুর্গম, তুষার ঢাকা পার্বত্য অঞ্চলে মৃত মানুষদের দেহ অনেক সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় না বা সৎকার করা সম্ভব হয় না। জঙ্গলে, খাদের ভিতর বা তুষার চাপা অবস্থায় পড়ে থাকে মৃতদেহ। ওদের প্রেতাত্মারাই নাকি ওয়্যার উফের রূপ ধারণ করে। এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে বহু সময় মারা হয় এই দুষ্প্রাপ্য প্রাণীগুলোকে।
গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অন্ধবিশ্বাস চট করে ভাঙা সম্ভব নয়। সে ধারণা এখন ভাঙতে গেলে বরং বিপদ হতে পারে। অনীশ তাই বলল, হ্যাঁ, ওয়্যার উলফের ব্যাপারটা আমিও শুনেছি। কিন্তু দুটো নেকড়ে তাড়া করেছিল আর ওই লোকগুলো সংখ্যায় দুজন ছিল বলেই কি ধরে নেওয়া যায় ওরা ওয়্যার উলফ?
নরবু বলল, শুধু সে কারণে নয়, যেখানে যেখানে দেহ মিলেছে সেখানেই তার পাশে পাওয়া গেছে মানুষের পায়ের ছাপ। ঘটনার আগে-পরে খামারের লোকগুলোকে জঙ্গলে ঢুকতে বেরোতেও দেখেছে অনেকে। যখন ওরা প্রথমে খামারটা খুলল তখন ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারিনি। সাহেব আর তার লোকজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্কই ছিল আমাদের, তারপর ধীরে ধীরে ওরা কথাবার্তা, কাজ কারবার বন্ধ করে দিল। ওরা মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। নেকড়ের রূপ ধরে। এমনকী যে-কোনও মানুষেরও রূপ ধরতে পারে ওরা। আপনি তো ওখানে আছেন শুনলাম। সাবধানে থাকবেন।
অনীশ বুঝতে পারল, ওয়্যার উফের ব্যাপারটা বেশ জেঁকে বসেছে এদের মাথায়। তাই সে তাদের আশ্বস্ত করার জন্য এবার অন্য কৌশল নিল। সে বলল, তোমাদের কথা আমি অবিশ্বাস করছি না। ইচ্ছা করলে তো আজকেই তুলে দেওয়া যায় খামারটা। কিন্তু তার জন্য আরও মজবুত প্রমাণ দরকার। ভাইমার সাহেব একটু সময় চাইছেন তোমাদের কাছে। তোমরা যদি আবার সরকারকে চিঠি দিয়ে অভিযোগটা তুলে নাও তবে তিনি আবার মাংস কিনবেন তোমাদের কাছ থেকে। গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি অর্থ সাহায্যও করবেন তোমাদের। তার কাছে যদি তোমাদের আরও কোনও দাবি থাকে তবে আমি তা নিয়ে তার সঙ্গে কথাও বলতে পারি। আমি তোমাদের চাপ দিচ্ছি না। শুধু একবার ভেবে দেখতে বলছি। উভয় পক্ষেরই কোথাও কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে।
তার কথা শুনে মাথা নাড়ল নরবু। তারপর বলল, ভুল আমাদের হচ্ছে না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। তবে আপনি সাবধানে থাকবেন। আমার বিশ্বাস ওরা নেকড়েই।
অনীশ আর কথা বাড়াল না। কাঠগোলাপের পুষ্পস্তবকটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, এবার আমি চলি। কাল আবার আসব।
পাহাড়ের ঢালের পাইনবনের মুখ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এল ড্রাইভার ছেলেটা। অনীশ তাকে বলল, গ্রামের তেমন কিছু খবর হলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমাকে জানাবে।
বনের মধ্যে দিয়ে একটু সাবধানে ফিরবেন।
পবন বলল, আচ্ছা সাহেব। কোনও খবর হলেই জানাব।
তাকে বিদায় জানিয়ে বনে প্রবেশ করল অনীশ। চারপাশে আবার সেই অদ্ভুত আলো আঁধারী পরিবেশ। গাছের পাতা থেকে জল খসে পড়ার টুপটাপ শব্দ। হিমেল বাতাস বনের মধ্যে এমনভাবে বয়ে যাচ্ছে যে ঠিক যেন ফিসফাস শব্দে কারা কথা বলছে পাইনগাছের আড়াল থেকে। পবন আর গ্রামবাসীদের কথা মেনে একটু সাবধানেই চলছিল অনীশ। ওয়্যার-উফের ভয়ে নয়। ওসবে সে বিশ্বাস করে না। তবে সত্যিকারের নেকড়ে বনে থাকতেই পারে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
হাঁটছিল অনীশ। হঠাই পাশেই একটা গাছের আড়াল থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে সে দিকে তাকাতেই দেখতে পেল গাছটার আড়ালে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার পোশাকের কিছুটা অংশ গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে।
অনীশ বলে উঠল, কে ওখানে? কে?
প্রশ্ন শুনে গাছের আড়াল থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখে অনীশ বেশ অবাক হয়ে গেল।