অনীশ বলল, আমি এখন গ্রামে যাব কথা বলতে। কীভাবে যাব পথটা দেখিয়ে দিন। দেখি তারা কী বলে?
ভাইমার বললেন, আমি কিন্তু যাব না আপনার সঙ্গে। আমাকে বাগে পেলে তারা খুনও করতে পারে। তাছাড়া কিছু লোকের আসার কথা এখানে।
অনীশ বলল, আমি একাই যাব। আমার ড্রাইভার পবন বাহাদুর ও গ্রামেই আছে। অসুবিধা হবে না।
ভাইমার বললেন, ঠিক আছে রাস্তাটা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
ভাইমারের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল ফোনে পবন বাহাদুরকে ধরল অনীশ। সে তাকে বলল গ্রামের লোককে জানিয়ে দাও আমি আসছি। তবে ওয়াইল্ড লাইফের লোক এ ব্যাপারটা তাদের বলার দরকার নেই। হয়তো তারা সেটা বুঝবে না। তাদের বোলো যে সরকারি তরফে আমি খোঁজ নিতে যাচ্ছি তাদের কাছে।
পবন বাহাদুর জানাল, ঠিক আছে স্যার। তবে এরা খুব খেপে আছে সাহেবটার ওপর।
ফোনটা জ্যাকেটের পকেটে রাখার পর অনীশ ভাইমারকে প্রশ্ন করল, কাদের আসার কথা এখানে?
ভাইমার জবাব দিলেন, তিব্বতী চীনাদের একটা দল। সীমান্ত পেরিয়ে ওপার থেকে আসবে ওরা আমাদের জন্য রেশন, পশুগুলোর জন্য মাংস ইত্যাদি নিয়ে। গত তিনমাস ধরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে সব লেনদেন তো বন্ধ। কাজেই ওই চীনারাই ভরসা। তা ছাড়া জিনিসপত্র কম দামেও দেয় ওরা।
তার কথা শুনে অনীশ মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, এভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা যাওয়া করা যায় নাকি?
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, স্থানীয় লোকরা করে। এখানে তো কাটাতারের বেড়া নেই। আপনি বুঝতেই পারবেন না কোনটা চীন আর কোনটা ইন্ডিয়া। দু-দেশের সীমান্তরক্ষীরা এ ব্যাপারে খুব একটা বাঁধা দেয় না। তবে যারা ওদেশ থেকে আসে তারা খুব বেশি নীচে নামে না, আর এ দেশের স্থানীয় মানুষরাও ও দেশের ভিতরে ঢোকে না। সীমান্তে উত্তেজনা না থাকলে স্থানীয়ভাবে এ ব্যাপারটা চলে।
ফাঁকা জমিটার যে দিকটায় বাইরের দিক থেকে পাইনবন কাঁটাতারের বেড়াকে প্রায় ছুঁয়ে আছে সেদিকটাতে ভাইমারের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল অনীশ। সেখানেও বাইরে যাবার একটা দরজা আছে। সে দরজার বাইরে থেকেই একটা অঁড়িপথ প্রবেশ করেছে পাইনবনের ভিতরে। দরজাটা খুলে শুড়িপথটা দেখিয়ে ভাইমার বললেন–এ পথটা যেমনভাবে গেছে তেমন তেমন। চলে যাবেন। একটু কোনাকুনি গেলেই ঢাল বেয়ে গ্রামে পৌঁছে যাবেন।
ঘেরা জায়গাটার বাইরে বেরিয়ে পাইবনে প্রবেশ করল অনীশ। বিরাট বিরাট সব গাছ। দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। তার ঋজু গুঁড়িগুলো সব সোজা উঠে গেছে ওপরদিকে। গাছগুলো কত প্রাচীন কে জানে! শ্যাওলার পুরু আবরণ জমে রয়েছে গায়ে। কোনও গুঁড়ির গায়ে জন্মেছে। থালার মতো বিরাট বিরাট ছত্রাক। একটা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বিরাজ করছে বনের মধ্যে। কেমন। যেন গা-ছমছমে রহস্য ভাবও আছে। ভাইমারের দেখানো শুড়িপথ দিয়ে হাঁটতে লাগল অনীশ। মাঝে মাঝে পাতা থেকে মাটিতে জল খসে পড়ার শব্দ অথবা বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। যে পথ ধরে অনীশ গাড়ি নিয়ে এসেছে তার ডানহাতেই মাইল তিনেক বিস্তৃত এই পাইনবন। তবে শুড়িপথটা পাইন বনের একটু ভিতরে ঢুকেই ভাইমারের নেকড়ে খামারের কোনাকুনি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে। সে পথই ধরল অনীশ।
কিছুক্ষণ চলার পরই বনটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেল। বনের বাইরে বেরিয়ে এল। অনীশ। বনের ঠিক বাইরে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। পাহাড়ি ছোট ছোট গ্রাম যেমন হয় এ গ্রামটাও তেমনই। পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো অনুচ্চ প্রাচীর ঘিরে আছে গ্রামটাকে। সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি ঘর হবে গ্রামে। ঘরগুলোর দেওয়াল পাথরের তৈরি। মাথার ওপর নীচু ছাদ। ঘেরা চৌহদ্দির একপাশে একটা খোঁয়াড়ও আছে। পশুর ডাকও ভেসে আসছে সেখান থেকে।
অনীশের আগমনবার্তা ড্রাইভার পবনের মাধ্যমে আগাম পেয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল গ্রামের লোকজন। তাদের মধ্যে পবনও ছিল। অনীশ ঢাল বেয়ে নীচে নামতেই তাকে বেশ খাতির করে গ্রামের ভিতর নিয়ে গেল কয়েকজন। একটা ফাঁকা জায়গাতে একটা পাথরের ওপর অনীশকে বসানোর পর তাকে ঘিরে দাঁড়াল।
গ্রাম্য গরিব পাহাড়ি মানুষ সব। পরনে শতছিন্ন শীতবস্ত্র। মাথায় টুপি। এই শীতেও অধিকাংশেরই খালি পা। বুড়ো বুড়ি, জোয়ান, বাচ্চা কাচ্চা মিলিয়ে একশজন মতো হবে। অনীশ বসার পর ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বুড়োলোক বেরিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। পবন তাকে দেখিয়ে বলল, স্যার, এ হল নরবু। গ্রামের মাথা। ওই কথা বলবে আপনার সঙ্গে।
নরবু! এ লোকটার নাম ভাইমারের মুখে শুনেছে অনীশ। লোকটার মাথায় একটা চামড়ার টুপি, গায়ে নোংরা জ্যাকেট। সম্ভবত বয়সের ভারেই একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে লোকটা। তার অসংখ্য বলিরেখাময় মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই তিব্বতী লোকটা এ জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে। তবে তার নরুন-চেরা জ্বহীন চোখের দৃষ্টি এখনও বেশ তীক্ষ্ণ। তার হাতে ছিল একটা কাঠগোলাপের স্তবক। সেটা সে অনীশকে দিল।
লোকটাকে একবার ভালো করে দেখে নেবার পর অনীশ বলল, তোমরা তো ওই নেকড়ে খামারটার ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছ। তাই আমি সরকারের তরফ থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আমি জানতে চাই আসল কারণটা কী?
নরবু একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা মানুষ মারতে শুরু করেছে। গত ছমাসে বেশ কজন মানুষের দেহ মিলেছে বনের মধ্যে।