বাইরে সূর্যালোক কিছুটা ঢুকছে ঘরের ভিতর। ঘরটার এক কোণে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বিরাট একটা রোমশ প্রাণী। অনীশ ভালো করে তাকাল প্রাণীটার দিকে। হ্যাঁ, টিবেটিয়ান উলফ বা তুষার নেকড়েই বটে। সাদাটে সোনালি বর্ণের প্রাণীটা ঘুমোচ্ছে। ঈষৎ ফাঁক করা মুখের ভিতর লাল জিভটা আর শ্বদন্তগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভাইমার বললেন, এদের দেহের লোমের বৈশিষ্ট্য জানেন তো?
অনীশ একবার দার্জিলিং চিড়িয়াখানায় অন্য একটা কাজে গিয়ে এই টিবেটিয়ান নেকড়ে দেখেছিল। এখানে আসার আগে প্রাণীটার সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনাও করে এসেছে। সে বলল, হা, জানি। প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই নেকড়েদের উলের রংও পরিবর্তিত হয়। কখনও কালচে, কখনও ধূসর, কখনও সোনালি আবার কখনও ধবধবে সাদা হয়। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে আত্মগোপন করা, শিকার ধরার কারণে প্রকৃতি এদের এ ক্ষমতা দিয়েছে।
ভাইমার বললেন, ঠিক তাই। দেখুন শীত আসছে বলে ওদের লোমের রং সাদা হতে শুরু করেছে।
অনীশ বলল, আর এও জানি এদের গ্রে উলফও যে বলা হয় তা কিন্তু এদের গাত্রবর্ণের ধূসরতার জন্য নয়। জন এডোয়ার্ড গ্রে নামের এক ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ১৮৬৩ সালে সর্বপ্রথম এই টিবেটিয়ান উল্ফের সন্ধান পান। তাঁর নাম অনুসারেই এদের বলা হয় গ্রে উলফ।
ভাইমার তার কথা শুনে বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাঃ, আপনি অনেক কিছু জানেন দেখছি। আর জানবেনই বা কেন! আপনাদেরও তো কারবার বন্যপ্রাণ নিয়ে। হয়তো বা আপনি আমার চেয়েও বেশি জানেন এদের সম্বন্ধে। বেশ বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন মিস্টার ভাইমার।
প্ৰথম খাঁচা ছেড়ে দ্বিতীয় খাঁচার সামনে গেল অনীশরা। সেখানেও কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা নেকড়ে। তৃতীয় খাঁচা, চতুর্থ খাঁচাতেও নেকড়ে আছে। অনীশের হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা প্রাণীগুলো সুস্থ তো? অনেক সময় অসুস্থ শ্বাপদেরা অন্য প্রাণীর পিছু ধাওয়া করতে না পেরে মানুষকে আক্রমণ করে।
অনীশ প্রশ্ন করল, ওরা সব ঘুমাচ্ছে কেন?
ভাইমার বললেন, এমনিতেই প্রকৃতির নিয়মে যারা রাতে জাগে তারা দিনের বেলা ঘুমায়। সারারাত ছোটাছুটি করে ওরা এখন ক্লান্ত।
এ কথা বলে হয়তো বা অনীশের মনের বক্তব্য পাঠ করেই ভাইমার বললেন, আপনি দেখতে চাইছেন তো ওরা সুস্থ কিনা? দাঁড়ান দেখাচ্ছি। এই বলে তিনি একটা খাঁচার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে টক্ শব্দ করলেন। কয়েকবার শব্দ করার পরই চোখ মেলল ঘরের কোণায় শুয়ে থাকা নেকড়েটা। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিশাল একটা হাই তুলল। আধো অন্ধকারে ঝিলিক দিয়ে উঠল তার ধবধবে সাদা শ্বদন্ত বা ক্যানাইনগুলো। ভাইমার এরপর খাঁচার গায়ে শব্দ করে তার উদ্দেশ্যে বললেন–কাম, কাম।
ঠিক যেন পোষা কুকুরের মতো অত বড় নেকড়েটা ভাইমারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল খাঁচার গায়ে। গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে প্রাণীটার মাথায় একবার আদর করলেন ভাইমার। ঘড়ঘড় করে একটা আদুরে শব্দ করল নেকড়েটা। তারপর খাঁচার ভিতর চারপাশে একবার পাক খেয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে থাবায় মুখ ঢেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে দেখে বোঝা গেল প্রাণীটা বেশ সুস্থ সবল।
শেষ খাঁচাটার সামনে গিয়ে এরপর দাঁড়াল অনীশ। কিন্তু তার ভিতর কোনও প্রাণী দেখতে না পেয়ে সে বলল, এই খাঁচার নেকড়েটা কোথায় গেল? বাইরে ছাড়া আছে নাকি?
ভাইমার হেসে বললেন, না, দিনের বেলায় ওদের বাইরে ছাড়া হয় না। ও খাঁচাতেই আছে।
কোথায়, খাঁচার ভিতর?
ভাইমার বললেন, ওই দেখুন খাঁচার এক কোণে একটা বড় গর্ত আছে। প্রতি খাঁচাতেই ওই গর্ত আছে। নেকড়েরা ঠান্ডা পড়লে বরফের নীচে গর্ত করে ঘুমায়। তাতে ঠান্ডা কম লাগে কারণ বাতাস গায়ে লাগে না বলে। এটা ওদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাস। সেজন্য খাঁচার ভিতরও সেই ব্যবস্থা করা আছে। প্রাণীটা গর্তের ভিতরে আছে। দেখি ওকে বাইরে বের করতে পারি কিনা? এই বলে মুখ দিয়ে টক্ শব্দ করতে লাগলেন ভাইমার। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরও প্রাণীটাকে বাইরে আনতে না পেরে তিনি বললেন, ও এখন আরাম ভেঙে বাইরে বেরোবে না। ও বড় শীতকাতুরে। যেই বাইরে বরফ পড়তে দেখল অমনি গতাঁর ভিতর গিয়ে সেঁধিয়েছে। ওকে নয় পরে দেখবেন।
অনীশ বলল, ঠিক আছে ওকে নয় পরেই দেখব।
প্রাণীগুলোকে দেখার পর আবার বাড়ির সামনের দিকে ফেরার পথ ধরল অনীশরা। ভাইমার বললেন, কেমন দেখলেন প্রাণীগুলোকে? খুব সুন্দর তাই না?
অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, খুব সুন্দর প্রাণী।
ভাইমার আক্ষেপের স্বরে বললেন, কেন যে সরকার অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের কথায় এত গুরুত্ব দিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে গুলি করে মারা হবে সেটা ভাবতে পারছেন!
অনীশ চিন্তিত ভাবে বলল, সত্যিই ওরা এই কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে যায় না তো?
ভাইমার বললেন, আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি ওরা এর বাইরে যায় না। যারা মারা গেছে সেগুলো হয় চিতাবাঘ বা অন্য কোনও নেকড়ের কীর্তি। নেকড়ের তো অভাব নেই এখানে। ভাবছি আমি একটা চেষ্টা করব। যে প্রাণীটা লোক মারছে তাকে ধরা বা মারা যায় কিনা দেখব। তার খোঁজে বন্দুক নিয়ে বনে ঘোরাও শুরু করেছিলাম কিন্তু গ্রামবাসীদের ভয়ে দিনের বেলা আর বাইরে বেরোতে ভরসা পাচ্ছি না। রাতেই না হয় বেরোব তবে। যদিও ব্যাপারটা বিপদজনক। তবুও সে চেষ্টাই করতে হবে। এতে যদি গ্রামবাসীরা সত্যিটা বুঝতে পারে।