বারান্দা বেয়ে কিছুটা এগিয়ে অনীশকে নিয়ে একটা ঘরে প্রবেশ করলেন ভাইমার। বেশ ছিমছাম সাজানো ঘর। খাট-বিছানা সবই আছে। ঘর সংলগ্ন টয়লেটও আছে। বাতিটা টেবিলের ওপর নামিয়ে ভাইমার বললেন, আপনি বিশ্রাম নিন। আমি এখন যাই। কাল সকালে আবার দেখা হবে। রাতে খাবার দিয়ে যাবে আমার লোক। তবে একটা কথা খেয়াল রাখবেন। রাতে মানুষের গলার শব্দ না শুনলে দরজা খুলবেন না। রাতে আমরা প্রাণীগুলোকে খাঁচার বাইরে বার করে দিই। ওদের সুস্থতার জন্যই এটা প্রয়োজন। যদিও ওরা আমাদের সঙ্গে প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই আচরণ করে। আপনাকেও কিছু করবে বলে মনে হয় না। তবু সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো।
মিস্টার ভাইমার চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে টয়লেটে যাবার পর পোশাক পালটে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল অনীশ। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিল সে। তারপর একসময় কৌতূহলবশত খাট সংলগ্ন জানলার পাল্লাটা খুলল।
পিছনের বরফ পাহাড়টা ধীরে ধীরে আলোকিত হতে শুরু করেছে। অন্ধকার কেটে গিয়ে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। অনীশ তাকিয়ে রইল সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদ উঁকি দিল পাহাড়ের আড়ালে। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন কেঁপে উঠল বাড়িটা। নেকড়ের ডাক! একযোগে ডেকে উঠল প্রাণীগুলো। চাঁদ ওঠার কারণেই রাত্রিকে আহ্বান জানিয়ে। চাঁদের সঙ্গে একটা আদিমতার সম্পর্ক আছে। নেকড়ে শেয়াল জাতীয় প্রাণীরা চাঁদ উঠলেই সেদিকে তাকিয়ে ডেকে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল সে ডাক।
তারপর একসময় থেমে গেল। বেশ ঠান্ডা বাতাস আসছে জানলা দিয়ে। কাজেই জানলা বন্ধ করে অনীশ আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত আটটা নাগাদ দরজায় টোকা দেবার শব্দ হল। তার সঙ্গে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, স্যার খাবার এনেছি। দরজা খুলল অনীশ। চীনা দেখতে একটা লোক খাবারের পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে। সমতলের লোকদের চোখে অবশ্য চীনা, নেপালি, ভুটিয়া ইত্যাদি পাহাড়ি লোকদের একইরকম দেখতে লাগে। ঘরে ঢুকে টেবিলে খাবারের পাত্রগুলো নামিয়ে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল অনীশ। টেবিলে সে রেখে গেছে রুটি আর ধোঁয়া ওঠা মুরগির মাংস। খাওয়া সেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানায় চলে গেল অনীশ। ঘুম নেমে এল তার চোখে। ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই যেন সে শুনতে লাগল বাইরে থেকে ভেসে আসা নেকড়ের ডাক।
২. যখন ঘুম ভাঙল
অনীশের যখন ঘুম ভাঙল তখনও ভোরের কুয়াশা কাটেনি। জানলাটা একটু ফাঁক করে সে দেখল বাইরেটা পুরো কুয়াশায় মোড়া। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে তার কর্মপন্থা ঠিক করে নিল। তিনটে দিন সে এখানে কাটাতে পারবে। তার মধ্যেই তাকে যা করার করতে হবে। এদিনের কর্মপন্থা হিসাবে সে ঠিক করে নিল আজ প্রথমে সে প্রাণীগুলোকে দেখবে। তারপর গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের বক্তব্য শুনবে। এ জায়গার চারপাশটাও সম্ভব হলে ঘুরে দেখবে।
পরিকল্পনা শেষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। মিনিট দশেক সময় লাগল তার তৈরি হতে। তার মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল। চা নিয়ে এসেছে একজন। কালকের লোকটা নয়, অন্য একটা লোক। যদিও তার চেহারাও একই রকম। সেও তিব্বতী বা সিকিমিজ হবে। লোকটা চা দিয়ে চলে যাবার পর দরজাটা খোলাই রেখেছিল অনীশ। বাইরের কুয়াশা এবার ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। অনীশের চা-পানের কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ভাইমার। অনীশকে দেখে তিনি বললেন, সুপ্রভাত। আশা করি রাতে ঘুম ভালো। হয়েছে?
অনীশও সুপ্রভাত জানিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, ঘুম ভালো হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আপনার পোষ্যদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। চলুন এবার তাদের দেখতে যাব। আমি তৈরি হয়েই আছি।
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, চলুন, তাদের দেখাতে নিয়ে যাব বলেই এসেছি আমি।
ঘর ছেড়ে বেরোল অনীশ। কুয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রভাতি সূর্যকিরণে ঝলমল করছে বরফমোড়া পাহাড়ের শিখরগুলো। শুধু পাশের পাইনবনটা তখনও পাতলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। কিন্তু বাড়িটার সামনে ফাঁকা জমিটার দিকে তাকিয়ে অনীশ বেশ অবাক হয়ে গেল। ছিট ছিট সাদা বিন্দুতে ছেয়ে আছে সারা জমিটা। অনীশ কিছু প্রশ্ন করার আগেই ভাইমার বললেন, কাল রাতে তুষারপাত হয়েছে। এ মরশুমের প্রথম তুষারপাত। আর কদিনের মধ্যে তুষারের চাদরে মুড়ে যাবে এ অঞ্চল। রেশম পথও তখন চলে যায় চার-পাঁচ ফুট বরফের নীচে। মাসখানেকের জন্য এ পথে বন্ধ হয়ে যায় মানুষের যাওয়া আসা। যতদিন না আবার আর্মির লোকরা ড্রেজিং করে বরফ সরিয়ে রাস্তা বার করে।
অনীশকে নিয়ে বারান্দা ছেড়ে নীচে নামলেন ভদ্রলোক। তারপর বাড়িটাকে বেড় দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনীশকে নিয়ে চললেন বাড়িটার পিছন অংশে। ভদ্রলোকের হাঁটার ধরন দেখে অনীশ বুঝতে পারল যে ভাইমারের ডান পায়ে কোনও ত্রুটি আছে।
ভাইমারের সঙ্গে বাড়ির পিছনে পৌঁছে গেল অনীশ। বাড়িটার লাগোয়াই পাথরের তৈরি। সার সার বেশ বড় বড় ঘর। তার সামনে লোহার গরাদ বসানো। একটা বোঁটকা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। চিড়িয়াখানার মাংশাসী পশুদের ঘরের সামনে গেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমনই গন্ধ। ভাইমার অনীশকে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন প্রথম খাঁচাটার সামনে।