এ কথা বলার পর আবারও একটু চুপ করে থেকে ভাইমার বললেন, গ্রামবাসীদের খ্যাপার কারণটা আসলে অন্য। ওদের গ্রামের প্রধান হল নরবু বলে একটা বুড়ো। পশুপালনের ব্যবসা করে সে। একসময় আমি তার কাছ থেকে নেকড়েগুলোর খাবারের জন্য পশু কিনতাম। কিন্তু এখন কিনি সীমান্তের ওপার থেকে আসা তিব্বতীদের কাছ থেকে। তিনভাগ কম দাম। আর এতেই খেপে গেছে বুড়োটা। আর গ্রামের লোককেও সেই খ্যাপাচ্ছে। এটাই হল আসল কারণ।
অনীশ বলল, আপনি তো জার্মানির লোক। এখানে এসে ঘাঁটি গাড়লেন কীভাবে?
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, আমি জার্মানির লোক। বারীয় পার্বত্য অঞ্চলে আমার বাড়ি। জার্মানীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জাগস্পিৎজ ওখানেই অবস্থিত। ছোটবেলা থেকেই বন্যপ্রাণীদের প্রতি আমার অসীম মায়া। ওখানকার পার্বত্য অঞ্চলে নেকড়েদের সংরক্ষণের জন্য আমি বেশ কিছু কাজও করেছিলাম আমার নিজস্ব এন.জি.ও-র মাধ্যমে। পাহাড়ি অঞ্চলে আমার ভ্রমণের শখও প্রবল। এখানে এসেছিলাম পায়ে হেঁটে সিল্ক রুট অতিক্রম করার জন্য। কিন্তু যাত্রাপথে একদিন চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া একটা অর্ধমৃত তুষার নেকড়ে। কোনওভাবে গুলি লেগেছিল প্রাণীটার পিছনের পায়ে। এমন প্রায়শই হয় এখানে। দু-দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলি বিনিময়ে প্রাণ যায় নিরীহ প্রাণীদের। কখনও বা মানুষেরও।
এখন বরফ মোড়া পাহাড়গুলোতেও সীমান্ত সুরক্ষার জন্য ঘাঁটি গাড়ছে দু-দেশের সেনারা। বিশেষত চীন সেনারা তাদের দিকের পাহাড়গুলোতে বহু ঘাঁটি গেড়েছে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে সেখানকার প্রাণীরা। তার মধ্যে টিবেটিয়ান উল্য অন্যতম। তারা নীচে নেমে আসছে। তারপর মারা পড়ছে গ্রামবাসী বা এ দেশের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে।
যাই হোক সেই নেকড়েটাকে আমি তুলে এনে সুস্থ করে তুললাম। তখনই আমার মনে হল আচ্ছা এই দুষ্প্রাপ্য প্রাণীগুলোর জন্য কোনও কাজ করা যায় না? এখানে উপযুক্ত জায়গা পেয়ে আমি খুলে বসলাম এই ক্যাম্পটা। একে একে আমি সংগ্রহ করলাম আরও কিছু নেকড়ে। তাদের অধিকাংশকেই আমি সংগ্রহ করি গ্রামবাসীদের খপ্পর থেকে বা বনের মধ্যে থেকে। তাদের কেউ অনাহারে অথবা আহত হয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় ছিল। মোট পাঁচটা নেকড়ে আছে আমার এই ক্যাম্পে। ওদের জন্যই দেশ ছেড়ে এতদূরে পড়ে আছি আমি।
ভাইমারের কথা শুনে অনীশ বলল, আপনার উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। বুঝতে পারছি প্রাণীগুলোর প্রতি আপনার মমতা অপরিসীম। কিন্তু মুশকিল হল সব মানুষ এ ব্যাপারটা অনুভব করতে পারে না। গ্রামবাসীরা এ ক্যাম্পটা উৎখাত করার জন্য আবেদন জানিয়েছে সরকারের কাছে। এ দেশের বড় চিড়িয়াখানাগুলো অধিকাংশই সমতলে। সেখানে গরমে প্রাণীগুলো বাঁচবে না। পাহাড়ি অঞ্চলের চিড়িয়াখানাগুলো খুব ছোট। সেখানে দু-একটা করে তুষার নেকড়ে আছে। পরিকাঠামোর অভাবে তারা নিতে চাচ্ছে না আপনার প্রাণীগুলোকে। কাজেই…।
অনীশ তার কথা শেষ না করলেও তার অনুচ্চারিত বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হল না ভাইমারের। একটু বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ জানি। ওরা এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতে চায়। দেখুন যদি আপনি কিছু করতে পারেন।
অনীশ বলল, হ্যাঁ এ কথা ঠিকই যে দুষ্প্রাপ্য বন্যপ্রাণীদের মারতে হলে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণ সংস্থার কিছু নিয়মনীতি মানতে হয় সব দেশের সরকারকে। নইলে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলের বরাদ্দ অর্থ বন্ধ হয়ে যায়। তবে অনেক দেশ অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে সে নির্দেশ মানে না। যেমন একবার আফ্রিকার একটা দেশে দশ হাজার হাতি মারার ব্যবস্থা করা হল। আমরা ব্যাপারটা আটকাতে পারিনি। দেখা যাক গ্রামবাসীদের অভিযোগপত্রটা প্রত্যাহার করানো যায় কিনা? সরকার তো সেটাকেই সামনে রাখছে।
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, আপনি সে চেষ্টাই করুন। প্রয়োজনে আমি ওদের থেকেই মাংস কিনব। গ্রামের উন্নতির জন্য কিছু অর্থ সাহায্যও করব। এ প্রাণীগুলোকে আমি কিছুতেই মরতে দিতে পারি না।
বাইরে পাহাড়ের আড়ালে মনে হয় সূর্য ডুবতে বসেছে। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে বাইরে। ঘরের ভিতরটাও অন্ধকার হয়ে আসছে। বিষণ্ণ, নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন ভাইমার।
অনীশও বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলল, আপনার প্রাণীগুলোকে একটু দেখা যাবে?
বাইরে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে এখন নয়। ওদের ঘরগুলোতে বা এ বাড়িতে আলো নেই। দিনের আলোতে কাল ভালো করে দেখবেন ওদের। অনেকটা পথ এসেছেন, এবার বিশ্রাম নেবেন চলুন। কাল দিনের বেলায় যা করার করবেন।
কথাটা মিথ্যা বলেননি ভাইমার। গতকাল রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু। করেছিল অনীশ। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ও ঘরে চেয়ারে বসার পর বেশ ক্লান্ত লাগছে। ঠান্ডাও লাগছে বেশ।
টেবিলের ওপর একটা সেজ বাতি রাখা ছিল। সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে অনীশকে সঙ্গে করে এরপর ঘর ছেড়ে বেরোলেন ভাইমার। বাইরে সূর্য ডুবে গেছে। দ্রুত অন্ধকারের চাদরে মুড়ে যাচ্ছে চারপাশের পাহাড়, গিরিপথ। বাইরে বেরিয়ে ভাইমারের পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে অনীশ প্রশ্ন করল, আপনার অন্য সব লোকজন কোথায়?
ভাইমার জবাব দিলেন, তারা নানা কাজে বাইরে গেছে। এখনই ফিরবে।