অনীশ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি মুহূতাঁর জন্য একবার গ্রামবাসীদের মধ্যে আপনাকে দেখেছিলাম। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। আমার দৃষ্টি বিভ্রম ভেবে আমি কথাটা বলিনি ছেত্রী সাহেবকে।
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা আপনার কাছে অবশ্যই অবিশ্বাস্য ছিল। ক্যাম্পে ঢুকে প্রথমে চারটে ওয়্যার উলকে পুড়িয়ে মারলাম আমরা। তারপর পুরো বাড়িটাতে আগুন লাগাবার আগে আমরা তল্লাশি শুরু করলাম পালের গোদা নেকড়েটার খোঁজে। একটা ঘরে তার দরজার একটা পাল্লার নীচের অংশ ভাঙা ছিল। নেকড়ের নখের অজস্র চিহ্ন ছিল দরজার গায়ে। সে ঘরের খাটের নীচে উঁকি দিতে দেখেই একটা লাশ। সেই দেহটা বার করতেই আমি চিনতে পারলাম তাকে। আপনার ড্রাইভার পবন। নরবুও চিনতে পারল তাকে। পবন নামের ওই লোকটাকে আমি আপনাকে গ্রাম থেকে পাইনবন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দেখেছি। তার গলার নলি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিল নেকড়ের দাঁতে।
অনীশ বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ওটাই আমার ঘর ছিল। তবে পবনকে খুন করে তার রূপ ধারণ করে খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ওয়্যার উলফটা? লেফটানেন্ট ছেত্রী মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলেন অনীশের কথায়।
ভাইমার এবার বললেন, ক্যাম্পটাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে প্রায় রাত হয়ে গেল। গ্রামে ফিরে এসে নরবুর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ব্যাপারটা খুলে বলা প্রয়োজন লেফটানেন্টের কাছে। নইলে হয়তো আমাকেই ওয়্যার উলফ ভেবে বা তাদের আশ্রয়দাতা ভেবে গুলি চালিয়ে মারবে সেনারা। একটা কাঠগোলাপের বোকে আর নরবুকে সঙ্গে নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সেনা ছাউনিতে। লেফটানেন্ট তখন আমারই সন্ধানে অর্থাৎ সেই ওয়্যার উলফ ভাইমারের সন্ধানে বেরোতে যাচ্ছিলেন। আমি আর নরবু তাকে খুলে বললাম সব কথা। ওর মুখেই শুনলাম আপনার ড্রাইভার পবন নাকি রওনা হয়েছে আপনাকে নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল সবকিছু। আপনার ড্রাইভার আসলে পবন নয়, সে আসলে পবনের রূপধারী ওয়্যার উলফ! সঙ্গে সঙ্গে আপনার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। ভাগ্যিস আমরা ঠিক সময় পৌঁছেছিলাম। আর একটু হলেই..। কথা শেষ করলেন ভাইমার।
অনীশের আর কিছু জানা বা বোঝার নেই। তাই আর কোনও প্রশ্ন করল না সে।
গাড়ি প্রথমে পৌঁছোল নাথুলা পাসের সেই ট্যুরিস্ট স্পটে। তারপর এগোল গ্যাংটক শহরের দিকে। দুপুরবেলা গ্যাংটক শহরে এক হোটেলে অনীশের আশ্রয় ঠিক করে বিদায় নিলেন। লেফটানেন্ট ছেত্রী আর ভাইমার। যাবার আগে লেফটানেন্ট আর একবার স্মরণ করিয়ে দিলেন তার কথা–আপনি যা দেখলেন, যা শুনলেন কাউকে তা বলতে যাবেন না। লোকে আপনাকে পাগল ভাববে।
অনীশ বলল, আচ্ছা। তবে চেষ্টা করবেন যাতে গ্রামবাসীরা নেকড়ে দেখলেই তাকে ওয়্যার উলফ ভেবে পুড়িয়ে না মারে।
ভাইমার আর লেফটানেন্ট ছেত্রী একসঙ্গে বলে উঠলেন, আমরা সে চেষ্টাই করব।
ভাইমার আর লেফটানেন্ট ছেত্রী চলে যাবার পর হোটেলের দোতলায় উঠে নিজের কামরাতে প্রবেশ করল অনীশ। খোলা জানলা দিয়ে দূরের পাহাড়শ্রেণি দেখা যাচ্ছে। ওদিকেই তো নাথুলা পাস। ওদিক থেকেই নেমে এসেছে সে। গ্যাংটক শহরে তুষারপাত না হলেও আকাশটা কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন। হয়তো বা বৃষ্টি হবে। ঘরের ভিতর বিরাজ করছে আধো অন্ধকার।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলতেই একটা লোক ঘরে ঢুকল। সে জানতে চাইল অনীশের কিছু প্রয়োজন আছে কিনা? হোটেলেরই কর্মচারী সে। তার চেহারা দেখে অনীশের মনে হল সে চীনা বা তিব্বতী হতে পারে। অনীশ তাকে বলল, কিছু খাবার দিয়ে যাও।
লোকটা অর্ডার নিয়ে চলে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় অনীশের হঠাৎ মনে হল, ঠিক এমনই একটা লোককে সে যেন দেখেছিল সেই নেকড়ে খামারে! এ লোকটাও ওয়্যার উলফ নয়তো?
অনীশ তাকে বলল, এক মিনিট দাঁড়াও।
দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা।
অনীশ ব্যাগ থেকে ভাইমারের উপহার দেওয়া সেই বুনো কাঠগোলাপের বোকেটা বার করে লোকটার হাতে ধরিয়ে বলল, এটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম।
লোকটা স্বাভাবিকভাবেই বোকেটা নিল। তারপর বলল, ধন্যবাদ স্যার। ওই যে নাথুলা পাসের ওদিকে পাহাড় দেখলেন ওখানেই ফোটে এই কাঠগোলাপ। এটা আমি বাড়িতে রেখে দেব। আপনি শহুরে মানুষ। হয়তো ওয়্যার উফে বিশ্বাস করেন না। সীমান্তে যারা যুদ্ধে মারা যায় তারা ওয়্যার উলফ–অপদেবতা হয়। নেকড়ে মানুষ! আমরা বিশ্বাস করি ব্যাপারটা। এই বুনো গোলাপের শুকনো ফুলও যদি বাড়িতে থাকে তবে ওই ওয়্যার উফরা বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না। অনেকদিন ধরে এ ফুল খুঁজছিলাম স্যার। এই বলে লোকটা ফুলের বোকেটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অনীশ চেয়ে রইল জানলার বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ কেটে গেল। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল বরফ ঢাকা পাহাড়ের মাথায়। অনীশের ঘরটাও ভরে উঠল আলোতে। অন্ধকার কেটে গেল। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের সূর্যালোকে উদ্ভাসিত পাহাড়শ্রেণির অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে অনীশ মনে মনে বলল, হয়তো বা পুরো ঘটনাটাই নিছকই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল!