এতক্ষণ ভাইমার সাহেব যা বললেন তার অনেকখানিই ফাইলে পড়েছে অনীশ। তবুও সে শুনে গেল তার কথাগুলো।
একটু থেমে ভাইমার সাহেব এরপর বললেন, কিন্তু এ সব ঘটনার সূত্রপাত মাস ছয় সাত আগে। ঠিক সেদিনের আগের রাতে আমি গুলির লড়াইয়ের শব্দ শুনেছিলাম আমার ক্যাম্পে বসে।
ভাইমারের কথার মাঝেই লেফটানেন্ট ছেত্রী এবার বললেন, হ্যাঁ, ওই রাতেই আমরা গুলি চালাই চীনা সেনাদের ওই পাঁচজন অনুপ্রবেশকারীকে লক্ষ্য করে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম সবাই নিহত হয়েছে। কিন্তু পরদিন অনেক অনুসন্ধান করেও তাদের কারো মৃতদেহ আমরা খুঁজে পাইনি।
ভাইমার সাহেব এরপর বললেন, যাই হোক সেদিন সারারাত গুলি যুদ্ধর পর, পরদিন সকালে পাইনবনের মধ্যে খুঁজে পেলাম একটা অর্ধমৃত নেকড়েকে। মর্টারের শেলের আঘাতে একটা পা ভেঙে গেছে তার। তবে অতবড় নেকড়ে আমি আগে কোনওদিন দেখিনি।
দানবাকৃতির নেকড়ে! ধবধবে সাদা গায়ের রং। ঠিক যেমন নেকড়েটাকে দেখেছিলেন আপনি। নেকড়েটাকে তুলে আমি ক্যাম্পে নিয়ে এসে কিছুদিনের মধ্যেই তাকে সুস্থ করে তুললাম। তবে তার পা-টা সম্পূর্ণ ঠিক হল না। সুস্থ হলেও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটত সে। তখন আমি বুঝতে পারিনি সে আসলে কে? তাকে ক্যাম্পে আনাই আমার কাল হয়েছিল। এর কয়েকদিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে ক্যাম্পে অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটতে লাগল। ধরুন আমার চারজন কর্মচারীদের কেউ বাইরে কাজে বেরিয়েছিল কিন্তু তারা সে রাতে আর কেউ ফিরল না।
পরদিন তারা যখন ফিরল তখন তারা কেমন যেন অচেনা মানুষ। হাজার জিগ্যেস করলেও তারা বলত না যে সারা রাত তারা কোথায় কাটিয়েছে। আর যেদিন তারা রাতে উধাও হত তার পরদিন ভোরেই জঙ্গলের মধ্যে খোঁজ মিলত এক একটা মৃতদেহর। সাধারণত নেকড়েরা কোনও কারণে মানুষ মারলেও তার মাথা খায় না। কিন্তু এই বিবস্ত্র দেহগুলোর মাথা থাকত না। তাই তাদের সনাক্তও করা যেত না। পরে বুঝেছিলাম যে সেগুলো আসলে ছিল আমার কর্মীদেরই দেহ। তাদের খেয়ে ফেলে পরদিন তাদের অবয়ব ধারণ করে ফিরে আসত এক একজন মৃত চীনা সেনা বা ওয়্যার উলফ। একে একে আমার চারজন কর্মীকেই মেরে তাদের জায়গা দখল করল তারা। তারপর একদিন আমার চারটে নেকড়েকেও কীভাবে যেন মেরে খাঁচার ভিতর ঢুকে তাদের জায়গায় নেকড়ে রূপ ধারণ করল তারা চারজন। আর তাদের দলপতি তো নেকড়েরূপে আগেই ছিল খাঁচার মধ্যে।
একদিন সকালে উঠে আমি আর আমার কোনও লোককেই খুঁজে পেলাম না। লোকগুলো গেল কোথায়? সেদিন সন্ধ্যায় আমি খাঁচার কাছাকাছি গিয়ে শুনলাম এক অদ্ভুত কথোপকথন। খাঁচার ভিতর থেকে একজন যেন বলছে সাহেবটাকে শেষ করে দিতে পারলেই আমরা দখল নিতে পারব বাড়িটার।
তার কথা শুনে আর একজন লোক যেন বলল, হ্যাঁ, দু-এক দিনের মধ্যেই কাজটা শেষ করব।
কথাবার্তাটা কানে যেতেই আমি চমকে উঠে খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোনও খাঁচায় কোনও লোক নেই। খাঁচার ভিতর থেকে নেকড়েগুলো যেন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে এ দৃষ্টি আমি কোনওদিন দেখিনি। সেদিনই আমার প্রথম সন্দেহ হয় ওয়্যার উফের ব্যাপারে। আমি ঘটনাটা বলার জন্য টেলিফোন করেছিলাম ছেত্রী সাহেবকে। কিন্তু উনি আমার কথা শুনে হাসলেন, আমিও ফোন রেখে দিলাম…।
লেফটানেন্ট ছেত্রী এ কথা শুনে বললেন, তখন এ কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না। আর আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আপনার নেকড়ের মৃতদেহ আমরা দু-দিন আগে বরফের তলা থেকে সংগ্রহ করেছি চীনা সৈনিকদের মৃতদেহ খুঁজতে গিয়ে।
ভাইমার আবার শুরু করলেন তার কথা–পরদিন রাতেই কীভাবে যেন বেরিয়ে পড়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করল আমার ওপর। বরাতজোরে আমি ক্যাম্প থেকে কোনওরকমে আত্মগোপন করলাম পাইনবনে। সেখানে বনের ভিতর এক জায়গাতে কাঠগোলাপের অনেক গাছ আছে সেখানেই। কারণ বনের ওই একটা অংশকেই এড়িয়ে চলে ওয়্যার উলফরা। কোথায় যাব আমি? কাকে বলব আমার কথা? কেউ বিশ্বাস করত না আমার কথা। তবে একজন বিশ্বাস করল আমার কথা। সে হল নরবু। তার দয়াতেই বাঁচলাম আমি। দুজনে মিলে আলোচনা করে ঠিক করলাম সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। তবে সে সুযোগ যে নরবুর নাতির প্রাণের বিনিময়ে আসবে তা জানা ছিল না আমাদের। অবশ্য একইভাবে এটাও সত্যি যে সেদিন রাতে খিদের জ্বালাতে নেকড়েগুলো যদি ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে ছেলেটাকে না মারত তবে হয়তো ঘটনাটার শেষ হত না। কতদিন আমি পাইনবনের ভিতর থেকে দেখেছি ক্যাম্পের ভিতর আমারই ভেক ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই বিশাল ওয়্যার উলটা। কিন্তু তাকে সে সময় চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না আমার।
লেফটানেন্ট ছেত্রী এরপর বললেন, পালের গোদা শয়তান নেকড়েটা দু-রাত আপনার রূপ ধরেও বেরিয়েছিল। ইচ্ছা করেই সে আমার সেনাদের বলেছিল যে আপনি নাকি এ জায়গায়। থেকে যেতে চান। কারণ, সে ভেবেছিল যে আসল ভাইমারকে সে যদি শেষ করতে না পারে, ভাইমার যদি আত্মপ্রকাশ করেন তবে আপনার রূপ ধরেই জায়গাটাতে থেকে যাবে সে। আমরা ঠিক সময় উপস্থিত না হলে তার ইচ্ছা হয়তো বাস্তব হত।
অনীশ এবার প্রশ্ন করল, কিন্তু আমার খোঁজ আপনারা পেলেন কীভাবে?
ভাইমার বললেন, গতকাল রাতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে ক্যাম্পটা জ্বালাতে গেছিলাম আমিও…।