ভদ্রলোক অনীশকে দেখতে পেয়ে একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে এসে পকেট থেকে চাবি বার করে দরজাটা খুললেন। তারপর তার দস্তানা পরা হাতটা করমর্দনের জন্য অনীশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আসুন, আসুন। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।
অনীশ করমর্দন করে ভিতরে প্রবেশ করল। দরজার তালাটা বন্ধ করতে করতে ভদ্রলোক বললেন, কীভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। কত দূর থেকে কত কষ্ট করে আপনি এখানে ছুটে এলেন। আপনারা যে আমার ডাকে শেষ পর্যন্ত সাড়া দেবেন তা আমি ভাবতেও পারিনি।
অনীশ বলল, ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। আমরা বন্যপ্রাণকে ভালোবাসি। তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করি। এটা আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে।
দরজাটা বন্ধ করার পর অনীশকে নিয়ে বাড়িটার দিকে এগোলেন ভাইমার। সেদিকে এগোতে এগোতে অনীশ জানতে চাইল, এ বাড়িটা কি আপনি বানিয়েছেন বা কিনেছেন?
ভাইমার বললেন, না। এ বাড়িটা একসময় তিব্বতী শরণার্থী শিবির ছিল। পরে ওরা এ বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। বাড়িটা পরিত্যক্ত ছিল। আমি বাড়িটা মেরামত করে নিই। বাড়িটা নেবার সময় সরকারের সঙ্গে ছোটখাটো একটা চুক্তিও হয়েছিল। তখন সরকার উৎসাহও দিয়েছিল এ কাজে। কিন্তু এখন…। কথাটা শেষ করলেন না ভাইমার।
বাড়িটার সামনে টানা লম্বা বারান্দা। কাঠের মেঝে, কাঠের দেওয়ালঅলা সারবাঁধা ছোট ছোট ঘর। কয়েকটা ঘর তালা বন্ধ, কয়েকটা ভোলা। অনীশকে নিয়ে বারান্দায় উঠে তেমনই একটা ঘরে প্রবেশ করলেন ভাইমার।
ঘরটা মনে হয় তার অফিস ঘর। একটা টেবিল ঘিরে বেশ কটা গদি আঁটা চেয়ার। দেওয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো বেশ কয়েকটা ওয়াইল্ড লাইফের ছবি। তার মধ্যে ভাইমারের চেয়ারের ঠিক পিছনের ছবিটা একটা হিমালয়ান উলফের। একটা কাঁচ ঢাকা আলমারিও আছে ঘরে। সেটাও ওয়াইল্ড লাইফ সংক্রান্ত বইপত্রে ঠাসা।
নিজের চেয়ারে বসলেন ভাইমার। অনীশ তার মুখোমুখি একটা চেয়ারে। সেখানে বসার পর একটা রাইফেলও চোখে পড়ল অনীশের। যে দরজা দিয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করেছে তার গা ঘেঁষেই দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে সেটা।
বেশ কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে বসে রইল তারা দুজন। বাইরে বিকাল নেমে এসেছে। আলো মরে আসছে। আধো অন্ধকার ঘর। মিস্টার ভাইমারই প্রথম মুখ খুললেন। তিনি বললেন, আপনি নিশ্চই সব ব্যাপারটাই মোটামুটি জেনেছেন আমার চিঠি আর কাগজপত্রের মাধ্যমে। এখন হয়তো আপনার রিপোর্টের ওপরই নির্ভর করছে প্রাণীগুলোর ভবিষ্যৎ।
অনীশ বলল, হ্যাঁ, মোটামুটি জানি। গ্রামের লোক সরকারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। আপনার নেকড়েগুলো এ জায়গা থেকে বেরিয়ে মানুষ মারছে বলে। আপনার চিঠি থেকে জেনেছি। তারা নাকি একবার কিছুদিন আগে হামলাও চালিয়েছিল এ জায়গাতে। প্রাণীগুলো কোথায় থাকে?
ভাইমার বললেন, ওরা এখানেই থাকে। বাড়ির পিছনে কয়েকটা লোহার গরাদঅলা পাথরের ঘরে। ওরা এ চত্বর ছেড়ে বা খাঁচার বাইরে কোনওদিন যায়নি। কোনও গ্রামবাসীকে মারেনি।
অনীশ বলল, গ্রামবাসীরা কি তবে মিথ্যা কথা বলছে? গত ছয় মাসে নাকি চারটে দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে তারা? সরকারের কাছে এমনই রিপোর্ট আছে।
ভাইমার বললেন, যে দেহাবশেষগুলো পাওয়া গেছে তাদের কেউ গ্রামবাসী নয়। তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। এমনই ক্ষতবিক্ষত ছিল দেহগুলো। তারা মিথ্যা আতঙ্কিত হচ্ছে। আমার ক্যাম্পের কোনও প্রাণী সে কাণ্ড ঘটায়নি। তারা বাইরে যায় না। খাঁচা ঘরে থাকে।
অনীশ একটু বিস্মিতভাবে বলল, তারা গ্রামবাসী নয় তা আমার জানা ছিল না। তবে মৃত মানুষগুলো কারা? কে মারল সেই লোকগুলোকে?
ভাইমার পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনি যখন ওয়াইল্ড লাইফ অরগানাইজেশনের লোক, তখন নিশ্চই এই হিমালয়ান উলফ বা টিবেটিয়ান উল্ফের ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে কিছুটা জানা আছে আপনার?
অনীশ জবাব দিল, যদিও আমি এদের নিয়ে তেমন কাজ করিনি তবে কিছুটা জানি। দুষ্প্রাপ্য প্রাণী। গায়ে বড় বড় লোম আছে। ধূসর এবং সোনালি রঙের। সাদা রঙেরও হয়। যে কারণে নানা নাম আছে এদের। কেউ বলেন টিবেটিয়ান গ্রে উল, কেউ বলেন গোল্ডেন উল আবার কেউ বলেন স্নো-উলফ। সাধারণত খরগোশ ইত্যাদি ছোটখাটো প্রাণী শিকার করে এই নেকড়েরা। কখনও কখনও দলবদ্ধভাবে হরিণ বা পাহাড়ি ছাগল জাতীয় প্রাণী অর্থাৎ ঘুরালও শিকার করে। অন্য প্রাণীদের মতোই মানুষকেও এড়িয়ে চলে ওরা।
অনীশের জবাব শুনে ভাইমার একটু খুশি হয়ে বললেন, ঠিক তাই। মানুষ ওদের সাধারণ খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পড়ে না। আত্মরক্ষার জন্য নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মানুষকে তারা আক্রমণ করে না। এটাই তো গ্রামের মানুষকে বোঝাতে পারছি না।
অনীশ আবার জানতে চাইল, তবে যে মানুষগুলো মরল তারা কারা? কে মারল ওদের? গ্রামের মানুষরাই বা হঠাৎ খেপে গেল কেন?
ভাইমার একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমার ধারণা যে মানুষগুলো মারা গেছে। তারা স্মাগলার। যে-কোনও সীমান্তেই চোরা কারবার হয় জানেন তো? সোনা ইত্যাদি অবৈধ পণ্য নিয়ে আসা যাওয়া করে তারা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বনের মধ্যে দিয়ে। সব কটা দেহই কিন্তু বনের মধ্যে পাওয়া গেছে। আমার ধারণা কাজটা চিতা বাঘের। মাউন্টেন লেপার্ড। বয়স বা কোনও আঘাত পাবার কারণে সে নরখাদক হয়েছে। তার পায়ের ছাপ দেখেছি আমি। প্রাণীটাকে মারার জন্য সন্ধানও চালাচ্ছি।