অনীশ বলল, কিন্তু ভাইমার? আসল যে লোকটা এই ওয়ার উলফগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল তার কী খবর। ধরতে পেরেছেন ভাইমারকে?
লেফটানেন্ট প্রথমে হাসলেন। তারপর ফিরে তাকালেন পিছন দিকে। কখন যেন সেখানে নিঃশব্দে হাজির হয়েছে একটা সামরিক জিপ। তার থেকে নেমে তুষারঝড়ের মধ্যে এগিয়ে আসছে। একজন। লোকটা কাছাকাছি আসতেই তাকে দেখে আবারও অনীশের হৃৎপিণ্ড যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। এগিয়ে আসছেন স্বয়ং ভাইমার। তার হাতে ধরা একটা কাঠগোলাপের বোকে!
খুঁড়িয়ে নয়, বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটা এসে দাঁড়াল অনীশের সামনে। তারপর মৃদু হেসে অনীশের উদ্দেশ্যে বলল, হ্যাঁ, আমিই ভাইমার। যে নেকড়ে খামারটা ছিল সেটা আমারই ছিল।
অনীশের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। তাই দেখে লোকটা বলল, আমি খোঁড়াও নই আর এই কাঠগোলাপের গন্ধ আমার বেশ ভালোই লাগে। ওয়্যার উরা ভয় পায় এই বুনো কাঠগোলাপকে। আপনি ওয়্যার উলফ কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যই প্রতি সকালে গ্রামবাসীরা এই কাঠগোলাপের স্তবক দিত আপনার হাতে। আমিই বনের ভিতর থেকে ফুল সংগ্রহ করে দিতাম নরবুকে। আপনার সঙ্গে আমার একদিন সত্যিই সাক্ষাৎ হয়েছিল পাইনবনের ভিতর। এটা আমার উপহার।–এই বলে তিনি ফুলটা ধরিয়ে দিলেন অনীশের হাতে।
অনীশের মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে অস্পষ্টভাবে বলল, আপনার সঙ্গে যদি আমার মাত্র একবার দেখা হয়ে থাকে তবে কোন ভাইমারের সঙ্গে তিনটে রাত নেকড়ে খামারে কাটালাম?
ভাইমার মাটিতে পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই লোকটার সঙ্গে। ওয়্যার উলরা আমার আপনার সবার দেহ ধারণ করতে পারে। ও করেও ছিল তা।
অনীশ বলল, আমার মাথার ভিতর সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! আপনারা কীভাবে এখানে উপস্থিত হলেন?
লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, চলুন আপনাকে পৌঁছে দেবার পথে সব কথা বুঝিয়ে দেব। ভয় নেই, আমরা কেউ ওয়্যার উলফ নই। আপনার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি সত্যি ভাইমার।
অনীশ এবার চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু আমার ড্রাইভার পবন কোথায় গেল?
লেফটানেন্ট সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, সে আর কোনওদিন ফিরবে না।
তারপর তিনি বললেন, মালপত্র নিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠুন। যা তুষারপাত শুরু হয়েছে তাতে দেরি হলে আপনাকে গ্যাংটক শহরে পৌঁছে দিয়ে আমরা আর ওপরে ফিরতে পারব না।
সৈনিকদের কয়েকজন চীনা সৈনিকের সেই দেহটাকে পোড়াবার প্রস্তুতি শুরু করল। তাদের সেখানে ছেড়ে রেখে লেফটানেন্ট অনীশ, ভাইমার আর দু-জন সেনাকে নিয়ে আর্মি গাড়িটাতে উঠে বসলেন। পাকদণ্ডী বেয়ে নামতে শুরু করল গাড়ি।
৯. রেশমপথ বেয়ে
রেশমপথ বেয়ে নীচে নামতে লাগল গাড়িটা। প্রথমে লেফটানেন্ট ছেত্রী আর ভাইমার চুপচাপ রইলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিহ্বল, উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অনীশ। হয়তো বা তাকে ধাতস্থ হবার জন্য কিছুটা সময় দিলেন তারা। তারপর প্রথমে অনীশের উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন ভাইমার। তিনি বললেন, ঘটনাটা তবে খুলেই বলি আপনাকে। আমার কথার কোনও অংশ। বুঝতে না পারলে প্রশ্ন করবেন।
অনীশ বলল, আচ্ছা।
একটু চুপ করে থেকে ভাইমার বলতে শুরু করলেন, আপনি যেমন বন্যপ্রাণ প্রেমী মানুষ আমিও ঠিক তেমনই মানুষ। আমার বাড়ি জার্মানীর বারীয় পর্বতাঞ্চলের যে অংশে সেখানে প্রচুর তুষার নেকড়ে পাওয়া যায়। তাই ছোটবেলা থেকেই ওদের সঙ্গে আমি পরিচিত, ভালোবাসি এই প্রাণীগুলোকে। খোঁজ নিলে দেখবেন ওদেশের নেকড়ে সংরক্ষণ আন্দোলনের সঙ্গেও আমি যুক্ত ছিলাম। সব দেশেই অত্যাচার চালানো হয় ওদের ওপর। কখনও বা তা চামড়ার জন্য, কখনও বা ওয়্যার উলফ ভেবে মারা হয় ওদের। যাই হোক এদেশে আমি প্রথম টিবেটিয়ান উলফের খোঁজে আসিনি। এসেছিলাম পায়ে হেঁটে সিল্করুট অতিক্রম করার জন্য। ট্রেকিং আমার অন্যতম নেশা। যাই হোক ট্রেকিং করতে করতে একদিন পাসের মধ্যে পেয়ে গেলাম একটা নেকড়েকে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল ওটা। জানলাম দু-দেশের সীমান্তে সৈনিকদের গুলিতে প্রায়শই এই ঘটনা ঘটে। রাতের অন্ধকারে নেকড়েগুলোকে ঠিক চিনতে না পেরে অপর পক্ষের সেনা আত্মগোপন করে আছে ভেবে গুলি চালায় সেনারা। তখন আমি আশ্রয় নিয়েছি যেখানে উলফ রিহ্যাবিলেটেশন ক্যাম্প করেছিলাম সেখানেই। বাড়িটা তখন পরিত্যক্ত ছিল। ট্রেকার্সরা মাঝে মাঝে রাত কাটাত সেখানে। যাই হোক সে বাড়িটাতে আমি তুলে আনলাম আহত নেকড়েটাকে। তার শুশ্রূষা করে তাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলতে লাগলাম।
নেকড়েদের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই আমার মমত্ব। তাই আমি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম পাস ধরে তিব্বত না গিয়ে আমি কাজ করব এই অসহায় প্রাণীগুলোর জন্য। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানালাম এ ব্যাপারে। তারাও স্বাগত জানাল ব্যাপারটাকে। আর্মিও ছাড়পত্র দিল ক্যাম্প খোলার জন্য। বাড়িটা মেরামত করে টিবেটিয়ান উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্প খুলে বসলাম আমি। স্থানীয় গ্রামবাসীরা তার নাম দিল নেকড়ে খামার। তাদের সঙ্গেও বেশ সুসম্পর্ক ছিল আমার। তারা আমার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছিল ঠিকই, কিন্তু নেকড়ে সম্পর্কে প্রচলিত ভয়ার্ত ধারণার জন্য তারা কেউ খামারে কাজ করতে চাইল না। তার ফলে সীমান্তর ওপার থেকে চারজন তিব্বতী শরণার্থীকে আমি খামারের কাজে নিয়োগ করলাম। তাদের সবাই সৎ, নিরীহ প্রকৃতির লোক ছিল। তবে গ্রামপ্রধান নরবুর থেকে খামার বা ক্যাম্পের রসদ সংগ্রহ করা হত। ভালোই চলছিল সবকিছু, একে একে আরও তিনটে, অর্থাৎ মোট চারটে নেকড়ে সংগ্রহ করলাম আমি…