অনীশের কথার প্রত্যুত্তরে প্রথমে একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ হল গাড়ির তলা থেকে। তারপর পবনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, হ্যাঁ, আমি এখানে। বেরোচ্ছি…।
গাড়ির সামনে থেকে অনীশ কয়েক হাত তফাতে সরে এল পবনকে বাইরে আসার সুবিধা করে দেবার জন্য। কিন্তু গাড়ির তলা থেকে তুষার ঝড়ের মধ্যে গুঁড়ি মেরে যে ধীরে ধীরে বাইরে বেরোতে শুরু করল তাকে দেখে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল অনীশের হৃৎপিণ্ড।
বিশাল একটা ধবধবে সাদা নেকড়ে বেরিয়ে আসছে গাড়ির তলা থেকে। জ্বলন্ত চোখ, চোয়ালে সার সার হিংস্র দাঁতের পাটির আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল জিভ, সাদা ফেনা ঝরছে তার থেকে। মুহূতাঁর মধ্যে তাকে চিনে ফেলল অনীশ। ভাইমারের সেই পালের গোদা ওয়্যার উলটা। যে হানা দিয়েছিল অনীশের ঘরে।
গাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে একবার হাঁ করল প্রাণীটা। ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো দেখিয়ে সে যেন হেসে অনীশকে বলল, এবার কোথায় পালাবে তুমি? সত্যিই অনীশের পালাবার পথ বন্ধ। রাস্তার একপাশে খাড়া পাথুরে দেওয়াল, অন্যপাশে পাইনবনের অন্ধকার খাদ। তার পিছনের রাস্তাটা তুষারঝড়ে অদৃশ্য আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেকড়েটা!
অনীশ তবুও কিছুটা ছুটে পাথরের দেওয়ালের একটা খাঁজে আত্মরক্ষার জন্য পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কীভাবে আত্মরক্ষা করবে অনীশ? তার কাছে একটা লাঠিও নেই। নেকড়েটা এবার এগোতে লাগল তার দিকে। ধীরে সুস্থে একটু যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে সে। শিকার ধরার কোনও তাড়া নেই তার। কারণ সে বুঝতে পেরেছে শিকারের পালাবার সব পথ বন্ধ। তার ধবধবে সাদা দেহ তুষারের সঙ্গে মাঝে মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তুষার ঝড়ের মধ্যে শুধু দেখা যাচ্ছে তার জ্বলন্ত চোখ দুটো আর টকটকে লাল জিভটা। জিভ চাটছে বীভৎস প্রাণীটা। জ্বলন্ত চোখ দুটো ক্রমশ এগিয়ে আসছে অনীশের দিকে।
হঠাৎ অনীশ তার পায়ের সামনেই বরফের মধ্যে পড়ে থাকা একটা পাথরখণ্ড দেখতে পেল। বাঁচার জন্য একটা শেষ চেষ্টা করল অনীশ। সে পাথরটা তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। পাথরটা আছড়ে পড়ল নেকড়েটার পিঠের ওপর। একটা রক্ত জল করা গর্জন করে প্রাণীটা প্রথমে লাফিয়ে উঠল। তার নখের আঘাতে ছিটকে উঠল বরফের ধুলো। আর এরপরই সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্রুত এগোতে লাগল অনীশের দিকে।
অনীশের হাত দশেক দূরে এসে থামল প্রাণীটা। কী হিংস্র তার চোখের দৃষ্টি। আদিম জিঘাংসার প্রতিমূর্তি যেন এই প্রাণীটা। পৃথিবীর সব বীভৎসতা, সব অশুভ শক্তি যেন সঞ্চারিত হয়েছে তার মধ্যে।
ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে উঠতে লাগল সেই ভয়ংকর, অশুভ জীবটার ঘাড় ও পিঠের রোমগুলো। থাবার থেকে উঁকি দিল ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ নখর। সে এবার ঝাঁপ দেবে শিকারকে লক্ষ্য করে। অসহায় অনীশ হাত দিয়ে তার গলাটা আড়াল করল যাতে সে প্রথমেই গলায় কামড় বসাতে না পারে। ধনুকের ছিলার মতো ওপর দিকে বেঁকে গেল জন্তুটার পিঠ। লাফ দেবার ঠিক আগের মুহূর্ত! ঠিক এই সময় প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। লাফ দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে কীসের যেন প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়ল হিংস্র প্রাণীটা। রক্তজল করা একটা বীভৎস আর্তনাদ ছিন্নভিন্ন করে দিল চারপাশের নিস্তব্ধতাকে। আর এর পরক্ষণেই অনীশের মাথার ওপর পাথরের দেওয়ালের ওপর থেকে ঝুপঝুপ করে লাফিয়ে নীচে নামল বেশ কয়েকজন সামরিক পোশাক পরা লোক। তার মধ্যে লেফটানেন্ট ছেত্রীও আছেন। এরপর একযোগে বেশ কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি একনাগাড়ে বর্ষিত হতে লাগল নেকড়েটার ওপর। গুলির আঘাতে উড়তে লাগল তার লোম, ছিটকে উঠতে লাগল তার রক্ত। বেশ কিছুক্ষণ গুলি বর্ষণের পর থামল সেনারা। ক্ষতবিক্ষত নেকড়ের দেহটার দিকে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে তাকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল সেনারা।
অনীশ এবার দেওয়াল ছেড়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল লেফটানেন্টের পাশে। তিনি অনীশের কাঁধে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করে বললেন, আর এখন ভয় নেই আপনার। আপনি সত্যি বেঁচে গেলেন এ যাত্রায়।
প্রত্যুত্তরে অনীশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় হঠাই নড়ে উঠল নেকড়ের মৃতদেহটা। একজন সেনা আবার গুলি চালাতে যাচ্ছিল কিন্তু ছেত্রীসাহেব ইশারায় থামতে বললেন। তাকে। এরপর দেহটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত-অবিশ্বাস্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল উপস্থিত সবাই। মাথার ওপর থেকে তুষার ঝরে পড়ছে দেহটার ওপর। নেকড়ের দেহটা প্রথমে দুমড়াতে-মুচড়াতে আরম্ভ করল, গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল মৃত নেকড়েটার মুখ থেকে। তারপর সবার চোখের সামনেই নেকড়ের দেহটা বদলে গেল একটা মানুষের মৃতদেহে। দীর্ঘকায় এক চীনার মৃতদেহ!
তার মুখটা যেন কেমন চেনা চেনা মনে হল অনীশের। লেফটানেন্টের কথায় তার ভাবনার উত্তর পেয়ে গেল অনীশ। তিনি বললেন, এ লোকটার ছবি আমি আপনাকে আমার ফাইল থেকে দেখিয়েছিলাম। পাঁচটা লোকের ছবি ছিল ফাইলে যাদের গুলি করে মারে আমাদের বাহিনী। এদের দলপতি ছিল এ লোকটাই। চীনা সৈন্যদের মধ্যে সাধারণত এমন লম্বা চওড়া লোক দেখা যায় না। আমাদের সেনা ছাউনিতে নাশকতা চালাবার জন্য এরই নেতৃত্বে আরও চারজন এদেশে ঢুকেছিল সীমান্ত পেরিয়ে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ওদের দলের শেষ লোকটাকে, শেষ নেকড়েটাকে খুঁজে পেলাম আমরা। তবে এ দেহটাকেও এখন পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হবে। নইলে অন্ধকার নামলেই বেঁচে উঠবে দেহটা।