দুজনে সুপ্রভাত বিনিময়ের পর লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, আপনি বেরোবার পর আমিও বেরোব ভাইমার আর তার নেকড়েটার খোঁজে। সেনারা তৈরি হচ্ছে। সমস্ত রাস্তা ইতিমধ্যে সিল করে দেওয়া হয়েছে। আপনি ছাড়া কেউ এখান থেকে বেরোতে পারবে না। যেভাবেই হোক শেষ ওয়্যার উলফটার হদিশ পেতে হবে ভাইমারের কাছ থেকে।
অনীশ বলল, ক্যাম্পটার শেষ অবস্থা কী?
লেফটানেন্ট জবাব দিলেন, সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। সারা রাত সেখানে তাণ্ডব চালিয়ে নিজেদের আক্রোশ মিটিয়ে ভোরবেলা গ্রামে ফিরে গেছে লোকগুলো। চারটে নেকড়েকেই পুড়িয়ে মারা হয়েছে। শুনলাম নাকি গায়ে আগুন লাগার পর নেকড়েগুলো আবার চীনা সৈনিকদের রূপ ধারণ করেছিল। ভকে ভকে রক্তবমি করছিল তারা। একজনের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। একটা কাটা আঙুল। সে আঙুলে একটা আংটি ছিল। যা দেখে গ্রামের লোকরা সেটা সেই নিহত ছেলের আঙুল বলে সনাক্ত করেছে। এই সুন্দর ভোরে, এসব কথা আর বেশি শুনতে ইচ্ছা করল না। অনীশ তার স্মৃতি থেকে যথাসম্ভব দ্রুত মুছে ফেলতে চায় এই অবিশ্বাস্য ভয়ংকর ঘটনাগুলোকে।
সে বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। হয়তো আপনার জন্যই ফেরা হচ্ছে আমার। তবে ভাইমার আর তার ওয়্যার উলফের সন্ধান পেলে আমাকে জানাবেন। সেই নেকড়েটা আমি দেখেছিলাম। ধবধবে সাদা রং, আকারে অন্য নেকড়েগুলোর প্রায় দ্বিগুণ। এবার তাহলে আমি চলি।
লেফটানেন্ট ছেত্রী তার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, হ্যাঁ, আসুন। আমাকেও বেরোতে হবে।
কিছুটা এগিয়ে অনীশ পবনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। সেনা ছাউনি ছেড়ে ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল অনীশ। সেই নেকড়ে ক্যাম্পের পাশ দিয়ে ফেরার পথে ক্যাম্পের সামনে গাড়ির গতি মৃদু কমিয়ে সেদিকে তাকাল পবন। অনীশও শেষ বারের মতো সেদিকে তাকাল। চারপাশের কাঁটাতারের বেড়াগুলোকে সব উপড়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িটার বদলে বিশাল জায়গা জুড়ে ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে শুধু দু-একটা অগ্নিদগ্ধ খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। তখনও কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে।
অনীশ স্বগতোক্তির স্বরে বলল, সবই ঠিক হল। একটাই শুধু ভয়, এখানে তো আরও নেকড়ে আছে, ভবিষ্যতে তাদের সবাইকেই না ওয়্যার উলঙ্ক ভেবে পুড়িয়ে মারে গ্রামবাসীরা।
তার কথা কানে যেতে বিষণ্ণ হেসে আবার গাড়ি গতি বাড়াল পবন।
পিছনে পড়ে রইল নেকড়ে খামার। একসময় রাস্তার পাশের সেই পাইনবনও হারিয়ে গেল। সে রাস্তা ছেড়ে পাসে প্রবেশ করল অনীশের গাড়ি। পাসের ভিতর অনেক বেশি তুষারপাত হচ্ছে। পথ, দু-পাশের প্রাচীর সবই তুষারে আচ্ছাদিত। শনশন শব্দে বাতাসও বইছে। শক্ত হাতে হুইল ধরে তুষার ভেঙে পাকদণ্ডী বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল পবন। অনীশ আর পবন দু জনেই নিশ্চুপ। হয়তো তারা দুজনেই ভাবছিল তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে একটার পর একটা বাঁক অতিক্রম করে নীচের দিকে নামতে লাগল গাড়ি। এ রাস্তাতেও আর আগের দিনের মতো দু-একজন লোকও চোখে পড়ছে না। নাগাড়ে কদিন ধরে তুষারপাতের ফলে লোকজনের চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই দেখে অনীশ একসময় মন্তব্য করল, রাস্তার যা অবস্থা তাতে ওপরে আর একদিন থাকলে আর ফেরা হত না।
তার কথা শুনে ঘাড় নাড়ল পবন।
সামনেই একটা বাঁক। তার একপাশে বরফ মোড়া পাহাড়, অন্য পাশে খাদের ভিতর থেকে উঠে এসেছে গভীর পাইনবন। তাদের মাথাগুলো সব তুষারের চাদরে মোড়া। সেই বাঁকের মুখে পৌঁছে হঠাৎই যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল গাড়িটা। পবন চাবি ঘুরিয়ে বার কয়েক গাড়িটাকে চালাবার চেষ্টা করল ঠিকই কিন্তু তাতে গোঁ গোঁ শব্দ হল কিন্তু গাড়ি স্টার্ট হল না। গাড়ি থেকে নেমে পবন প্রথমে গাড়ির সামনের বনেটটা খুলল। ইঞ্জিনটা দেখতে লাগল সে।
গাড়ির ভিতরে বসে অনীশ জানতে চাইল, কী হয়েছে? পবন জবাব দিল, ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার। একবার গাড়ির নীচে ঢুকে দেখি। নইলে মেকানিক ডাকতে হবে ফোন করে। এই বলে পবন গাড়ির বনেট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে গাড়ির তলায় ঢুকে গেল। গাড়ির তলায় খুটখাট শব্দ শুরু হল। অনীশ তাকিয়ে রইল রাস্তার পাশের পাইনবনের দিকে। খাদের ভিতর যে জায়গা থেকে গাছগুলো ওপরে উঠে এসেছে সে জায়গাটাতে কী অন্ধকার। সূর্যের আলো প্রবেশ করে না সেখানে। হয়তো বা ওরকম জায়গাই নেকড়েদেরও প্রিয়। সেদিকে তাকিয়ে এ সব নানা কথা ভাবতে লাগল অনীশ। সময় এগিয়ে চলল।
একটা সময় সে জায়গায় বেশ তুষারপাত শুরু হল। ঠিক সে সময় অনীশের খেয়াল হল গাড়ির তলা থেকে আর যেন কোনও শব্দ কানে আসছে না। ইতিমধ্যে মিনিট পনেরো সময় কেটে গেছে। অনীশ হাঁক দিল–পবন? পবন? কিন্তু পবনের কোনও সাড়া মিলল না। পবন কি তবে অনীশকে গাড়িতে একলা রেখে মেকানিকের খোঁজে গেল? কিন্তু এ রাস্তায় সে। মেকানিক পাবে কোথায়?
ব্যাপারটা বোঝার জন্য গাড়ি থেকে অনীশ লাফিয়ে নীচে নামল। গাড়ির বাইরে ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবল তুষারপাত শুরু হল। তার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র কনকনে বাতাস। কিছুটা তফাতেই সব কিছু যেন তুষার ঝড়ে অদৃশ্য লাগছে। পিছনের পথটাতে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল অনীশ। তারপর শেষ একবার গাড়ির নীচের দিকে তাকিয়ে বলল, পবন তুমি কি গাড়ির তলাতেই আছ?