কে যেন বলে উঠল, মৃতদেহগুলো কোথায় গেল?
খাঁচার সামনে প্রহরারত সেই আতঙ্কিত সেনাদের একজন বলে উঠল, অন্ধকার নামতেই মৃতদেহগুলো যেন ঘুম ভেঙে প্রথমে নড়ে উঠল। তারপর ওরা ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনেই নেকড়ে হয়ে গেল!
লোকটার কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই চারটে নেকড়ে খাঁচার গরাদের ওপর এসে কঁপাতে শুরু করল। আর তার সঙ্গে কী বীভৎস চিৎকার তাদের। যেন খাঁচার বাইরে একবার আসতে পারলেই তারা ছিঁড়ে খাবে সবাইকে। আদিম হিংসার প্রতিমূর্তি যেন প্রাণীগুলো। নাকি প্রেতমুর্তি?
হতভম্ব অনীশের পাশে দাঁড়ানো লেফটানেন্ট ছেত্রী বিস্মিতভাবে প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, সত্যিই তবে এরা ওয়্যার উলফ! সত্যিই এরা আছে!
অনীশ যেন নিজের চোখ কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু সে ব্যাপারটা অবিশ্বাসও করে কীভাবে। চীনাদের শবগুলো তো এ খাঁচাতেই রাখা হয়েছিল। তাছাড়া লোকদুটোও তো নিজের চোখে…।
হতভম্ব হয়ে খাঁচার দিকে চেয়ে রইল সবাই। নেকড়েগুলো খাঁচার গরাদগুলোর ওপর ঝাঁপাচ্ছে, সীমাহীন আক্রোশে কখনও কামড় বসাচ্ছে লোহার গরাদগুলো ভেঙে ফেলার জন্য। রক্তাক্ত হয়ে উঠছে প্রাণীগুলোর মুখ। বীভৎস এক দৃশ্য!
সম্বিত ফিরে পেয়ে এক জওয়ান হঠাৎ বলল, গুলি চালাব স্যার?
লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত এদের ওপর গুলি চালিয়ে কোনও লাভ হবে না। চীনা আর্মির লোকরা তো গুলি খেয়েই মরে ছিল…।
অন্য একজন বলল, তাহলে স্যার?
লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, এদের ব্যবস্থা সম্ভবত কিছু সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে। ওই দেখো…।–এই বলে তিনি আঙুল নির্দেশ করলেন পাইনবনের দিকে। সার সার মশালের আলো সেদিক থেকে এগিয়ে আসছে কাঁটাতারের দিকে। অন্ধকার নামতেই গ্রামবাসীরা ক্যাম্প জ্বালিয়ে দিতে আসছে হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য।
লেফটানেন্ট এরপর বললেন, এখন আর আমাদের এখানে থাকার দরকার নেই। বলা যায় না ভুল বোঝাবুঝি হয়ে তাদের আক্রমণ আমাদের ওপরও বর্ষিত হতে পারে। তখন আমাদেরও বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হবে। অযথা কিছু মানুষের প্রাণহানি হবে।
এ কথা বলে তিনি এগোলেন জায়গাটা ছেড়ে যাবার জন্য। বাড়ির সামনের অংশে এসে গাড়িতে উঠে বসল সবাই। কাঁটাতারের বাইরে এসে পবন আর্মি গাড়ি থেকে নেমে উঠে বসল নিজের গাড়িতে। গ্রামবাসীরা তখন পৌঁছে গেছে কাঁটাতারের গায়ে। খুঁটি উপড়ে ফেলল তারা। তারপর চিৎকার করতে করতে ছুটল বাড়িটার দিকে। গাড়ি দুটোও সে সময় একইসঙ্গে রওনা হল সেনা ছাউনির দিকে। শেষবারের মতো নেকড়ে খামারটার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস যেন চোখে পড়ল অনীশের। মশাল হাতে বাড়িটার দিকে ধাবমান জনতার প্রথম লোকটাকে যেন ভাইমারের মতো লাগল! কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
গাড়ি দুটো সেনা ছাউনির দিকে যেতে যেতেই নেকড়ে খামারের দিকে আকাশটা লাল হতে লাগল। সেদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল জনতার আক্রোশধ্বনি আর নেকড়েগুলোর আর্তনাদ। বাড়িটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনা ছাউনিতে পৌঁছে গেল অনীশরা। এটাও কাঁটাতার ঘেরা। অনেক লোকজন সেখানে। অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে সামরিক বাহিনীর লোকজন। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া জায়গাটা। দুটো গাড়ি প্রবেশ করল সেখানে। অনীশ আর পবনের জন্য দুটো আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হল। লেফটানেন্ট ছেত্রীর তত্ত্বাবধানে রাতের খাওয়া সাঙ্গ হবার পর অনীশকে তার ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন লেফটানেন্ট। বিদায় নেবার আগে তিনি বললেন, আমরা আজ যা দেখলাম, যা শুনলাম তা শুধু আমাদের অভিজ্ঞতা থাকাই বাঞ্ছনীয়। বাইরের কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না। আমাদের পাগল ভাববে। আমার চাকরি যাবে আর আপনার ওয়াইল্ড লাইফের পদও।
অনীশ হেসে বলল, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমি ওয়াইল্ড লাইফকে রিপোর্ট করব যে ক্যাম্পের নেকড়েগুলো বাইরে বেরিয়ে গ্রামবাসীকে মেরেছিল। তাই তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে ক্যাম্পটা। নেকড়েগুলোও মারা পরেছে তাতে। কিন্তু ভাইমার এবং আর একটা নেকড়ে?
লেফটানেন্ট ছেত্রী বললেন, সম্ভবত তাদের খুঁজে বার করব আমি। নেকড়েটাকে পুড়িয়ে মারব আর ভাইমারকে গ্রেপ্তার করব। আমিও আপনার মতো একই রিপোর্ট দেব সরকারের ঘরে।
অনীশ এবার শেষ প্রশ্নটা করল, আমি তাহলে কাল রওনা হতে পারি তো?
লেফটানেন্ট ছেত্রী বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনাকে আর আটকে রাখব না। যা তুষারপাত শুরু হয়েছে তাতে হয়তো পরশুই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি আর ফিরতে পারবেন না। কাল ভোরের আলো ফুটলেই রওনা হয়ে যাবেন আপনি।
এ কথা বলার পর ছেত্রী সাহেব একটু যেন ইতস্তত করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা শেষ প্রশ্ন করি–গত দু-দিন কি অন্ধকার নামার পর সত্যিই ক্যাম্পের বাইরে বেরোননি আপনি?
অনীশ জবাব দিল, না, বেরোইনি।
ছেত্রী বললেন, তাহলে হয়তো ভুল দেখেছিল আমার লোকরা। রাতের ব্যাপার তো, এমন ভুল হয়। যান এবার নিশ্চিন্তে ঘুম দিন। আশা করি ভাইমার সাহেবের নেকড়েরা এখানে আপনাকে আর বিরক্ত করবে না। শুভরাত্রি। এই বলে অনীশের থেকে বিদায় নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানাতে শুতেই ক্লান্ত-অবসন্ন অনীশের চোখে ঘুম নেমে এল।
৮. সূর্যদেব সবে উদয় হচ্ছেন
ভোর। অনীশ যখন তার ঘরের দরজা খুলল তখন সূর্যদেব সবে উদয় হচ্ছেন বরফ পাহাড়ের মাথায়। তবে ঝিরিঝিরি তুষারপাত হচ্ছে। হয়তো বা সারা রাত ধরেই এমন তুষারপাত হয়েছে। সেনা ছাউনির ঢালু ছাদগুলো ঢাকা পড়ে আছে সাদা তুষারের তলায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল অনীশ। পবন হাজির হয়ে গেছে তার দরজার বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন লেফটানেন্ট ছেত্রীও।