ভাইমার তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে গতকালের ঘটনাটা নিছকই দুর্ঘটনা বলে। তবে?
প্রাণীটা গতকালের নেকড়েটার মতোই মাথা দিয়ে ঠেলে ভাঙার চেষ্টা করছে দরজার ওপরের প্যানেলটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনীশ তাকিয়ে রইল তার দিকে। থরথর করে কাঁপছে দরজাটা। নেকড়ের মাথার চাপে মচমচ্ করে শব্দ হচ্ছে পুরোনো আমলের কাঠের দরজা থেকে। বাইরে বাতাসের শনশন শব্দ। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠছে। এই বুঝি নিভে গেল সেটা।
এ নেকড়েটা অন্য নেকড়েদের চেয়ে অনেক বড়, অনেক শক্তিধর। তার বিশাল মাথার চাপে সত্যি একসময় খসে গেল আর একটা প্যানেলও। বেশ বড় একটা ছিদ্র তৈরি হল দরজার নীচের অংশে। মুহূর্তের জন্য একবার থমকে অনীশের দিকে তাকাল শ্বাপদটা। তারপর প্রথমে সামনের পা দুটোকে দরজার এ পাশে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে গুঁড়ি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকতে শুরু করল।
প্রাণীটা তখন প্রায় তার দেহের অর্ধেক অংশটা ঢুকিয়ে ফেলেছে ঘরের মধ্যে, ঠিক সেই সময় হুঁশ ফিরল অনীশের। যেভাবেই হোক আটকাতে হবে নেকড়েটাকে। কিন্তু কীভাবে? তার কাছে তো তেমন কিছুই নেই। প্রাণীটা ক্রমশ ঢুকে আসছে ঘরের মধ্যে। মানুষ যখন প্রচণ্ড বিপদে পড়ে তখন খড়কুটো ধরেও বাঁচার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক সময় ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও সেটাই সত্যি।
টেবিলের ওপরই রাখা ফুলের বোকেটা তুলে নিয়ে সেটাই সে ছুঁড়ে মারল নেকড়েটাকে লক্ষ্য করে। প্রাণীটার কাঁধে গিয়ে পড়ল বোকেটা। কিন্তু তাতেই এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। ফুল নয় যেন কেউ কোনও একটা ভারী কিছু জিনিস দিয়ে আঘাত করেছে অথবা যেন তাকে আগুন ছুঁড়ে মেরেছে এমনভাবে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে উঠল নেকড়েটা। তারপর কোনওরকমে তার দেহটা হাচোড়-প্যাচোড় করে দরজার বাইরে বার করে নিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আক্রোশে গর্জন করতে লাগল প্রাণীটা। অনীশও বুঝে উঠতে পারল না যে ব্যাপারটা কী ঘটল? সে চেয়ে রইল দরজার ফাটলটার দিকে। বোকে থেকে ফুলগুলো খসে পড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে। দরজার ওপাশে গর্জন করেই চলেছে প্রাণীটা। কী রক্তজল করা তার ডাক! যেন অনীশকে নাগালের মধ্যে পেলেই সে তার কুঁটি ছিঁড়ে নেবে।
সময়ের পর সময় কেটে যেতে লাগল। দরজার দু-পাশে দাঁড়িয়ে রইল অনীশ আর নেকড়েটা। শেষ রাতের দিকে ধীরে ধীরে কমে এল নেকড়ের ডাকটা। তার ক্রুদ্ধ গর্জন দরজা ছেড়ে দূরে চলে যেতে লাগল। কতক্ষণ এভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল তা নিজেরও খেয়াল ছিল না অনীশের। একসময় সে দেখল দরজার ফোকর দিয়ে যেন আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। ভোর হচ্ছে বাইরে।
৬. দুঃস্বপ্নের রাত
দুঃস্বপ্নের রাত অতিবাহিত হল শেষ পর্যন্ত। বাইরে সূর্যোদয় হয়েছে। অনীশ জানলা খুলতেই একরাশ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। বাইরের দিকে তাকিয়েই অনীশ বুঝতে পারল গতকাল অন্ধকার নামার পর থেকেই আরও অনেক তুষারপাত হয়েছে। অন্তত চার-পাঁচ ফুট বরফের চাদরে ঢেকে গেছে মাটি। বাড়িটার সামনের বা পিছনের কোনও অংশ থেকেই কোনও শব্দ আসছে না।
ঘরে আলো ঢুকতেই মনে অনেকটা বল ফিরে এল অনীশের। সে মনে মনে ভাবল যে যাবার আগে গত রাতের ব্যাপারটা নিয়ে একবার জবাবদিহি চাইবে ভাইমারের কাছে। পরপর দু-রাত ভাইমারের অসতর্কতার জন্য প্রাণ যেতে বসেছিল তার। গ্রামবাসীদের অভিযোগ এবার সত্যি বলে অনীশের মনে হল। ওয়্যার উলফ না হলেও তার নেকড়েগুলোই হয়তো ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে একের পর এক মানুষ মেরেছে। ভাইমার ঘটনাটা যতই অস্বীকার করুন না কেন এ ব্যাপারটাই সম্ভবত সত্যি। কপাল ভালো যে পরপর দু-রাত বেঁচে গেছে অনীশ।
অনীশের ঘড়ির কাটায় সাতটা বাজল একসময়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোবাইলও বেজে উঠল। ড্রাইভার পবনের ফোন। সে বলল, আমি চলে এসেছি স্যার।
অনীশ বলল, ঠিক কোথায় তুমি?
পবন বলল, ঠিক গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে। ভিতরে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে গেট খোলা।
অনীশ বলল, দাঁড়াও আমি ঘরের বাইরে বেরোচ্ছি।
দরজা খুলল অনীশ। বাইরেটা পুরো তুষারে মুড়ে আছে। এমনকী বঁটাতারগুলো থেকেও ঝুলের মতো তুষার ঝুলছে। বারান্দার মেঝেও ঢেকে গেছে বাতাসে ভেসে আসা তুষারে। পবনকে দেখে হাত নেড়ে ভিতরে ঢোকার ইঙ্গিত করল অনীশ। চীনাদের তাঁবুটারও এখন কোনও চিহ্ন নেই। আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও ভাইমার বা তার লোকজনকেও দেখতে পেল না অনীশ।
পবন হাঁটু পর্যন্ত বরফ ভেঙে বারান্দায় উঠে এল। তার চোখে মুখে কেমন যেন উত্তেজনার ছাপ। দরজার সামনে এসে বারান্দার মেঝের দিকে তাকিয়ে সে আঁতকে উঠে বলল, ওটা কী?
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনীশ দেখল দরজার বাইরে তুষারের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে নেকড়ের অসংখ্য পায়ের ছাপ! গতরাতের ঘটনার চিহ্ন। অনীশ জবাব দিল, গত রাতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। একটা নেকড়ে দরজা ভেঙে ঢুকতে যাচ্ছিল। কোনওমতে বেঁচে গেছি!
অনীশের কথা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে গেল পবনের মুখ। অনীশ তাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার পর পবন উত্তেজিতভাবে বলল, ওদিকে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছে। তাই গ্রামে থাকা সুবিধার মনে হল না। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
অনীশ বলল, কী ঘটনা?
পবন বলল, কাল সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে এসে ছেলেটাকে যে পাওয়া যায়নি সে খবর দেবার পর গ্রামের লোকরা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল দল বেঁধে। পাস থেকে যে রাস্তাটা এদিকে ঢুকেছে সেখানে জঙ্গলের মধ্যে ছেলেটার দেহর কিছু অংশ মিলেছে। নেকড়ে খাওয়া দেহ। সম্ভবত গত পরশু রাতে তাকে ধরেছিল নেকড়েগুলো। গ্রামবাসীরা প্রচণ্ড উত্তেজিত। তারা হয়তো সত্যিই পুড়িয়ে দেবে এই ক্যাম্প। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে ফেরা যায় ততই ভালো।