নরবু জবাব দিল, সে এখনও ফেরেনি। তার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা।
ফেরেনি! বিস্মিত ভাবে বলল অনীশ।
নরবু বলল, না, এখনও ফেরেনি। গতকাল সন্ধ্যার আগেই তার ফেরার কথা ছিল। পায়ে হেঁটেই ফেরার কথা তার। গ্যাংটক থেকে গাড়ি তাকে ওপরে পাসের মুখে পৌঁছে দিয়েছিল। সে যে পাসে ঢুকেছিল সে খবরও পেয়েছি। কিন্তু তারপর আর তার কোনও খবর নেই। সে না এলে কিছু হবে না।
এর জবাবে অনীশ বলল, তোমরা চাইলে লেখাটা আমি পড়ে শোনাতে পারি।
নরবু প্রত্যুত্তরে স্পষ্টভাবে বলল, আপনি এখন ফিরে যান। নাতিটার না ফেরা নিয়ে আমরা সকলে খুব চিন্তায় আছি। সে ফিরে এলে আমরা আপনাকে খবর দেব।
সমস্যায় পড়ে গেল অনীশ। পরদিনই তো তাকে ফেরার পথ ধরতে হবে। তার মধ্যে যদি নরবুর নাতি না ফেরে? অনীশ পবনকে বলল, তুমি একটা কাজ করো। আমাদের সঙ্গে তো গাড়ি আছে, সেটা নিয়ে তুমি পাসে গিয়ে, সম্ভব হলে পাসের একটু ভিতরে গিয়ে তার। সন্ধান নিতে পারো। কিন্তু মুশকিল হল তুমি তাকে চিনবে কীভাবে?
পবন বলল, আমি তাকে চিনি স্যার। এর আগে যখন গ্রামে এসেছিলাম তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।
অনীশ আর তার ড্রাইভারের কথোপকথন শুনে নরবু ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দেখো তাকে খুঁজে পাও কিনা। এমনও হতে পারে কোথাও সে তুষারপাতে আটকে পড়েছে। তোমরা তাকে খুঁজে না পেলে আমরা গ্রামের লোকরা মিলে আশেপাশের জায়গাগুলোতে তাকে খুঁজতে বেরোব।
অনীশ এরপর আর সেখানে দাঁড়াল না। পবনকে নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পবন বলল, ছেলেটা না ফেরায় এখন ওদের মনে অন্য ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।
অনীশ প্রশ্ন করল, কী ভয়?
পবন বলল, গতকাল সন্ধ্যায় খামার থেকে ক্ষুধার্ত নেকড়ের ডাক ভেসে আসছিল গ্রামে। ওদের মনে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধছে যে…।
পবন তার কথা শেষ না করলেও তার সম্পূর্ণ বক্তব্য বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না অনীশের। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। সেজ বাতির আলোতে দরজার ফোকর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই নেকড়েটা! তার সেই লোলুপ ক্ষুধার্ত দৃষ্টি, লাল জিভ, চোয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁত! সেই নেকড়েটাই কোনওভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটায়নি তো?
অনীশের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মুখে সে শুধু বলল, তেমন কিছু ঘটলে ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর হবে।
পবন বলল, হ্যাঁ, সাহেব, নেকড়ে সমেত খামারে আগুন লাগিয়ে দেবে ওরা।
বাকিটা পথ তারা দু-জন কেউ কোনও কথা বলল না। আশঙ্কা দানা বাঁধছে দুজনের মনেই। বন পেরিয়ে ঢাল বেয়ে বড় রাস্তায় নামল তারা। ক্যাম্পের দিকে কিছুটা এগোতেই পিছন থেকে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আর্মি গাড়িটা তাদের পাশে এসেই দাঁড়াল। চালকের পাশের আসনেই বসে আছেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। পবনকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি অনীশকে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাচ্ছেন এখন?
অনীশ বলল, আমি এখন ক্যাম্পেই ফিরছি। তবে আমার ড্রাইভারকে পাঠাচ্ছি পাসের মুখটাতে। শহর থেকে একটা ছেলের ও পথ ধরেই গতকাল গ্রামে ফেরার কথা ছিল। সে ফেরেনি। তাই আমার ড্রাইভার তার খোঁজে ওদিকে যাচ্ছে।
ছেত্রী এরপর বললেন, শুনলাম আপনি নাকি কিছুদিনের জন্য ওই ক্যাম্পেই থাকছেন? এখন ফিরছেন না?
অনীশ বিস্মিতভাবে বলল, আমার তো কালই ফিরে যাবার কথা। এ খবর আপনাকে কে দিল?
লেফটানেন্ট বললেন, আমাকে নয়, আমার এক সৈনিককে কথাটা বলেছেন ভাইমার। গতকাল সন্ধ্যায় যখন তুষারপাত হচ্ছিল তখন টহল দিয়ে ফিরছিল আমার এক সৈনিক। ক্যাম্পের গেটের মুখে তার সঙ্গে ভাইমারের দেখা হয়। গত কয়েকমাস ধরে আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলতেন না তিনি। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় নিজেই সেই সৈনিককে ডাকেন। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। কথা প্রসঙ্গে তিনিই তাকে ব্যাপারটা বলেন।
অনীশ বলল, না না, আমার তেমন কোনও কথা হয়নি ভাইমারের সঙ্গে।
অনীশের জবাব শুনে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল লেফটানেন্টের মুখ। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, থাকুন বা নাই থাকুন আপনি কিন্তু গতরাতের মতো বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। সীমান্ত অঞ্চল। রাস্তা চিনতে না পেরে ওদেশে ঢুকে পড়লেই পিপিলস আর্মির হাতে গুপ্তচর সন্দেহে বলি হবেন। এভাবে অনেক নিরীহ মানুষ বন্দি হয়েছে ওদের কাছে।
এবার তার কথা শুনে আরও অবাক হয়ে গেল অনীশ। সে বলল, আমি কাল ঘরে ঢোকার পর বাইরে বেরোইনি তো!
লেফটানেন্ট ছেত্রী বলল, কিন্তু আমাদের এক গার্ড নাইট ভিশন ফিল্ড গ্লাসে আপনাকে দেখতে পেয়েছিল বলল। তার তো ভুল দেখার কথা নয়!
অনীশ এবার বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, হ্যাঁ, সে ভুল দেখেছে। আমি বাইরে যাইনি।
দু-পাশে মাথা নাড়লেন ছেত্রী। যেন তিনি বুঝতে পারছেন না সেই গার্ড নাকি অনীশ, কে সত্যি বলছে। এরপর তিনি আর কথা বাড়ালেন না। তার ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করলেন গাড়ি এগোবার জন্য।
লেফট্যানেন্ট চলে যাবার পর ক্যাম্পের দিকে এগোল তারা দু-জন। গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল তারা। পবনকে অনীশ বলল, ছেলেটার খোঁজ জেনে সঙ্গে সঙ্গে জানিও আমাকে।
পবন বলল, আচ্ছা স্যার।
সে গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর কিছুটা হেঁটে তার কাঁটা ঘেরা ক্যাম্পের ভিতর প্রবেশ করল অনীশ। বরফ ঢাকা চত্বরটার ঠিক মাঝখানে তাবু খাটাচ্ছে চীনাগুলো। তাদের ভারবাহী পশুগুলো অবশ্য সেখানে নেই। হয়তো তারা বাড়ির পিছনের দিকেই রয়ে গেছে। ভাইমারকেও দেখতে পেল না অনীশ। ঘরে ঢুকে হঠাৎ তার খেয়াল হল ফুলের বোকেটা বাইরে ফেলা হয়নি। জানলাটা বন্ধ। একটু পরে সেটা ফেলে দিলেও চলবে। সেটা টেবিলের ওপর রেখে জিরিয়ে নেবার জন্য খাটের ওপর বসল অনীশ।