অনীশ বলল, হ্যাঁ, যাব। কোনও খবর আছে নাকি?
পবন একটু ইতস্তত করে বলল, এখানে তো গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়ে। তার ওপর কাল সন্ধ্যা থেকেই তুষারপাত শুরু হয়েছিল। চাঁদ ওঠার কিছু পরে তুষারপাত দেখার জন্য আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি গ্রামপ্রধান নরবু একা তুষারপাতের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে বেরোচ্ছে। কৌতূহলবশত আমি এগোলাম তার পিছনে। সে আমাকে দেখেনি। নরবু ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে পাইনবনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক। সে নরবুকে নিয়ে পাইনবনের ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর বেশ কিছু সময় পর বন থেকে বেরিয়ে এক গ্রামে ফিরে এল সে।
অনীশ প্রশ্ন করল, লোকটা কে? কেমন দেখতে।
পবন মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, সম্ভবত ভাইমার সাহেব।
ভাইমার সাহেব! বেশ অবাক হয়ে গেল অনীশ। তবে ভাইমার কি গোপনে সন্ধি করতে গেছিলেন গ্রামের মাথা নরবুর সঙ্গে? অনীশ অবশ্য এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না পবনকে। শুধু বলল, ঠিক আছে। চোখকান খোলা রেখো। তেমন কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।
বিছানা ছেড়ে উঠে অনীশের কিছুক্ষণ সময় লাগল তৈরি হয়ে নিতে। দরজা খুলেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল সে। সামনের চত্বর তো বটেই, এমনকী চারপাশের সবকিছু সাদা হয়ে গেছে তুষারপাতের ফলে। পাইনবনের মাথাটাও পুরো সাদা!
বারান্দাটা পুরো ফাঁকা। ভাইমার বা তার কর্মচারীরা কেউ কোথাও নেই। বারান্দা ছেড়ে নীচে নামল অনীশ। সঙ্গে সঙ্গে তার দু-পা ডুবে গেল তুষারের মধ্যে। জমির ওপর অন্তত এক ফুট তুষার জমেছে। সারা রাত ধরে এতটা তুষারপাত হয়েছে তা ধারণা করতে পারেনি অনীশ। বাড়ির সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে পেঁজা তুলোর মতো তুষার মাড়িয়ে অনীশ এগোল বাড়িটার পিছন দিকে। বাড়িটাকে বেড় দিয়ে বাঁক ফিরতেই অনীশ কিছুটা তফাতেই দেখতে পেল ভাইমার আর তার এক কর্মচারীকে। ভাইমার তার কর্মচারীকে ধমকে বললেন, তুমি ওখানে গেছিলে কেন?
কর্মচারীটা যেন মাথা নীচু করে জবাব দিল, এভাবে আর পারছি না স্যার।
ভাইমার এরপর কিছু একটা যেন বলতে যাচ্ছিলেন তার লোকটাকে। কিন্তু অনীশকে দেখতে পেয়ে থেমে গেলেন। অনীশের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, সুপ্রভাত। ঘুম কেমন হল?
অনীশ জবাব দিল, ভালো।
ভাইমারের সেই লোকটা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইমার তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাও। খাঁচাগুলোর সামনে তেরপলের পরদা টাঙাবার ব্যবস্থা করো যাতে ঠান্ডা বাতাস আটকানো যায়।
তার কথা শুনে লোকটা ধীরে ধীরে চলে গেল খাঁচাগুলোর দিকে।
সে চলে যাবার পর ভাইমার বললেন, এই নেকড়েগুলো বরফের দেশের প্রাণী। বরফ। বা তুষারপাতে ওদের কিছু হয় না। কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে ওরাও কাবু হয়ে যায়। সহ্য করতে পারে না। বাতাসের থেকে বাঁচার জন্য বরফে গর্ত খুঁড়ে থাকে। দেখেছেন কাল কেমন তুষারপাত হয়েছে। এমন আর দু-তিন দিন হলে সিল্ক রুট, নাথুলা পাস বন্ধ হয়ে যাবে।
অনীশ বলল, হ্যাঁ। দেখলাম। কাল রাতে নেকড়েগুলোকে খেলতেও দেখলাম সামনের চত্বরে। তার মধ্যে একটা নেকড়ে কী বিশাল! সুন্দর! ওই নেকড়েটাই তো কাল খাঁচার গর্তে লুকিয়ে ছিল তাই না?
ভাইমার হেসে বললেন, হ্যাঁ। ধবধবে সাদা বিশাল নেকড়ে। যাদের দেখলেন তাদের মধ্যে প্রথম ওই আসে এই ক্যাম্পে। ওকেই অন্য প্রাণীগুলোর দলপতি বলা যেতে পারে। এত সুন্দর প্রাণীগুলো মারার চেষ্টা হচ্ছে আপনি ভাবতে পারছেন। বিষণ্ণতা নেমে এল ভাইমারের মুখে।
অনীশ বলল, আমি এখন গ্রামে যাব কথা বলতে। দেখি ওদের মত পরিবর্তন করা যায় কিনা? তবে সময় তো বেশি নেই। হাতে আজ আর কালকের দিনটা আছে। পরশু ভোরে আমাকে ফিরতে হবে। এ দেশে আমাদের বন্যপ্রাণ সংস্থার প্রধান প্রতিনিধি যিনি, সেই ডক্টর মাধবনও আমাকে বলেছেন যে প্রাণীগুলোকে বাঁচাবার জন্য যেন আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। একটা কথা আপনাকে বলতে পারি যে আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না।
বিষণ্ণ হেসে ভাইমার বললেন, চেষ্টা করে দেখুন ওই নরবু বলে লোকটাকে অভিযোগ ওঠাতে রাজি করাতে পারেন কিনা? ভাইমার কিন্তু একবারও বললেন না যে গতরাতে নরবুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা। অনীশও তাকে প্রশ্ন করা সমীচীন মনে করল না। ভাইমার এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে তুষারের মধ্যে দিয়ে এগোলেন অনীশকে কাঁটাতারের বাইরে বার। করে দেবার জন্য। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছে তার মুখ।
অনীশ বাইরে বেরোবার সময় তিনি একবার শুধু বললেন, তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবেন। দুপুরের পর থেকেই আবার গতকালের মতো প্রকৃতির রূপ বদলাতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে তুষার পড়তে শুরু করবে।
পাইনবনে প্রবেশ করল অনীশ। আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলো আজ ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাতাসে পাইনবনের ডাল-পাতা থেকে টুপটাপ তুষারকণা ঝরে পড়ছে অনীশের গায়ে। বনটাকে যেন আজ আরও বেশি নিঝুম মনে হচ্ছে। অজানা কোনও এক কারণে যেন আজ থমকে আছে সারা বন। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে একসময় ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গ্রামে পৌঁছে গেল অনীশ। গ্রামে নরবু সহ অন্যদের জমায়েত দেখে অনীশের মনে হল লোকগুলো যেন তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ অনীশ আজও গ্রামে ঢুকতেই নরবু তার হাতে গতদিনের মতোই একটা কাঠ-গোলাপের তোড়া দিয়ে তাকে সম্মান জানাল।