অনীশ এরপর আর এ প্রসঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বলল, আচ্ছা আপনার তো চারজন কর্মচারী। দু-জনকে দেখলাম। অন্য দুজন কোথায়?
ভাইমার হেসে বললেন, আপনার কি মনে হয় তারা দু-জন ওয়্যার উলফ? গ্রামের লোকরা বলেছে নাকি এ কথা?
ভাইমারের এ কথা শুনে অনীশ একটু লজ্জিতভাবে বলল, না, না, সে কথা নয়। আমি এ সবে বিশ্বাস করি না। আসলে তাদের দেখিনি তাই বললাম।
ভাইমার বললেন, নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে সবাই। ঠিক আছে আপনার কৌতূহল নিরসনের জন্য ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার চলি তাহলে। বাইরেটা অন্ধকার হয়ে আসছে।
ভাইমার বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যি দু-জন লোক এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। ভাইমার তাদের পাঠিয়েছেন। তাদের দেখেই অনীশ বুঝতে পারল ভাইমারের আগের দু-জন কর্মচারীর সঙ্গে এ দু-জন লোকেরও ছবি আছে তার ফাইলে। অর্থাৎ চারজন লোককেই দেখা হয়ে গেল তার। সে দুজন লোকের মধ্যে একজন একটু ইতস্তত করে অনীশের উদ্দেশ্যে বলল, স্যার, আমাদের কোনও প্রশ্ন করবেন? সাহেব আমাদের পাঠালেন।
তার তেমন কিছু প্রশ্ন করার নেই লোকগুলোকে। সে শুধু তাদের দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু লোকগুলো অনীশের কাছে জানতে চাওয়ায় সে প্রশ্ন করল, তোমরা এখানে কী কাজ করো?
একজন লোক জবাব দিল, পশুগুলোর যত্ন নিই। তাছাড়া ক্যাম্পের নানা কাজ।
অনীশ বলল, এই ক্যাম্প যদি না থাকে তখন?
তার কথা শুনে অন্য লোকটা ভয়ার্তভাবে বলল, ক্যাম্প না থাকলে আমরা কোথায় যাব স্যার? পেটের ব্যাপার। আমাদের কথা ভাববেন স্যার। ভাইমার সাহেবের দয়ায় এই ক্যাম্পে আমরা খেতে পরতে পারছি।
বাইরেটা আরও অন্ধকার হয়ে আসছে। খোলা দরজা-জানলা দিয়ে তীক্ষ্ণ কনকনে বাতাস ঢুকছে ভিতরে।
অনীশ লোক দুজনের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা এখন যাও। আমি দেখছি কী করা যায়। আর সাহেবকে বোলো রাতে খাবার লাগবে না। সঙ্গে খাবার আছে সেগুলো খাব।
অনীশকে সেলাম ঠুকে চলে গেল লোকদুটো। দরজা-জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল অনীশ।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অনীশ। তার যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল গড়িয়ে অনেকক্ষণ হল সন্ধ্যা নেমেছে। জানলার বাইরে থেকে কীসের যেন অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে।
অনীশ জানলা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাতাসের সঙ্গে জানলার গরাদের ফঁক গলে বিন্দু বিন্দু কী যেন এসে পড়ল তার গায়ে। তুষার! তুষারপাত যেন শুরু হয়েছে কখন। পিছনের পাহাড়ের মাথায় ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে। তার আলোতে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। তুষারে ঢেকে গেছে পিছনের জমিটা। নিশ্চয়ই সামনের জমিটাও একইভাবে বরফে ঢেকে গেছে। অনীশ এর আগে কোনওদিন তুষারপাত দেখেনি। জানলাটা বন্ধ করে খাট থেকে নেমে সে দরজাটা খুলল। হা, সামনের ফাঁকা জমিটা সাদা হয়ে গেছে তুষারে। তারপরই সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।
বারান্দার বাইরে তুষারপাতের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে পাঁচটা নেকড়ে। ফাঁকা জমিটার মধ্যে উল্লাসে ছোটাছুটি করছে তারা। কখনও বা একে অন্যের পিছু ধাওয়া করছে খেলার ছলে। তাদের পায়ের আঘাতে তুষার উড়ছে বাতাসে। এই নেকড়ের দলের মধ্যেই ধবধবে সাদা বিশালাকার একটা নেকড়ে দেখতে পেল অনীশ। আকারে সেটা অন্য চারটে নেকড়ের থেকে অনেক বড়। অনীশ আগে তাকে দেখেনি। সম্ভবত এটাই সেই পঞ্চম নেকড়ে যেটা খাঁচার গতাঁর ভিতর লুকিয়ে ছিল। একমাত্র এই নেকড়েটাই কিন্তু ছোটাছুটিতে অংশ নিচ্ছে না। এক জায়গাতে চুপচাপ বসে অন্যদের ওপর নজর রাখছে।
দূর থেকে একবার যেন ঘাড় ফিরিয়ে অনীশের ঘরের দিকে তাকাল সে। তারপর একবার মুখটা হাঁ করল। এত দূর থেকেও যেন তার টকটকে লাল জিভ আর তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দেখতে পেল অনীশ। শ্বাপদের দাঁত! মুহূর্তের জন্য কেমন যেন শিরশির করে উঠল অনীশের গা। এরপর চাঁদের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল প্রাণীটা। আর সঙ্গে সঙ্গে অন্য চারটে নেকড়ে যে যেখানে ছিল থমকে দাঁড়িয়ে গলা মেলাল তার সঙ্গে। তুষারপাতের মধ্যে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে যেন আদিমতা জেগে উঠল প্রাণীগুলোর মধ্যে।
হাজার বছর ধরে, যুগ যুগ ধরে এমনই রাত্রির আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসেছে তারা। রাত্রির সন্তানদের অপার্থিব সঙ্গীত মূৰ্ছনা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল নির্জন পাহাড়ের বুকে। এ অভিজ্ঞতা অনীশের কোনওদিন হয়নি। মাঝে মাঝে একটু থেমে থেমে একইভাবে ডেকে উঠতে লাগল প্রাণীগুলো। সে ডাক শুনে অনীশের কোনও সময় মনে হল তা যেন প্রকৃতির সন্তানদের উল্লাসধ্বনি আবার কোনও কোনও সময় মনে হতে লাগল সেটা তাদের আত্মবিলাপ, ক্রন্দনধ্বনি। অনীশ দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তাদের।
সময় কাটতে লাগল। কিন্তু একসময় প্রচণ্ড তুষারপাত শুরু হল। বাতাসও বইতে লাগল শনশন করে। তার ঝাপটায় তুষার এসে লাগতে লাগল অনীশের মুখে। তার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও প্রচণ্ড। অনীশ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালাল সে। তারপর সঙ্গে আনা বিস্কুট, শুকনো খাবার খেয়ে বাতি নিভিয়ে রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ কীসের যেন একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। দরজার কাছ থেকে শব্দটা আসছে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত খসখসে শব্দ! সঙ্গের টর্চটা জ্বালিয়ে দরজার দিকে আলো ফেলল অনীশ। তারপর বলে উঠল, কে? পুরোনো কাঠের প্যানেলঅলা দরজাটা একবার যেন কেঁপে উঠল। তারপর সব শব্দ থেমে গেল। হয়তো বা বাতাসের আঘাতেই শব্দটা হচ্ছে। দরজা কেঁপে উঠছে। টর্চ নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল অনীশ। কিন্তু ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝেই যেন শব্দটা কানে বাজতে লাগল। তার। অদ্ভুত একটা খসখস্ শব্দ!
৪. মোবাইলের রিংটোনের শব্দে
ভোর ছটা নাগাদ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল অনীশের। ওপাশ থেকে ড্রাইভার পবন বলল, গুড মর্নিং স্যার। আপনি কি আজ আসছেন?