ক্যাম্পে পৌঁছে গেল অনীশ। বাড়িটার সামনের জমিটায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গতকাল তালা খুলে দিয়েছিলেন ভাইমার। কিন্তু অনীশ খেয়াল করল আজ দরজায় তালা দেওয়া নেই। হয়তো বা তার জন্যই তালাটা খুলে রাখা হয়েছে। গেটের ফাঁক দিয়ে ওপাশে হাত গলিয়ে ওপাশের ছিটকিনি খুলে ভিতরে প্রবেশ করল অনীশ। ঠিক সেই সময় মাথার ওপরের আকাশটাতে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এল। পাহাড়ি অঞ্চলে সারাদিনই এমন মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা চলে। ফাঁকা জমি পেরিয়ে বারান্দায় উঠল অনীশ। সেখানেও কোনও লোকজন নেই।
নিজের ঘরে ঢুকে কিন্তু অনীশ দেখতে পেল তার টেবিলে খাবার রাখা আছে। ধোঁয়া উঠছে তার থেকে। অর্থাৎ কিছুক্ষণ আগেই খাবার দিয়ে গেছে কেউ। ভাইমার কি ফিরেছেন বাইরে থেকে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। এতটা পথ হাঁটার ফলে বেশ খিদেও পেয়েছিল তার। কাজেই খাওয়া সেরে নিয়ে বিছানায় বসল সে।
জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন আধো-অন্ধকার ভাব। পিছনের বরফ পাহাড় থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে অনীশ লেফটানেন্ট ছেত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথনগুলো ভাবতে লাগল। ছেত্রী কি সন্দেহ করছেন এ বাড়িতে অন্য কেউ ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে? কথাটা মনে হতেই নিজের সঙ্গে আনা ফাইলটা খুলল অনীশ। ভাইমার সহ তার কর্মচারী চারজনের ছবি আর পাঁচটা নেকড়ের ছবি আছে ফাইলটাতে। ভাইমারের যে দুজন। সঙ্গীকে অনীশ ইতিমধ্যে দেখেছে তাদের মধ্যে দুজনের ছবি দেখে চিনতে পারল অনীশ। মনে মনে সে ভেবে নিল ভাইমারের কর্মচারীদের মধ্যে বাকি দুজনের চেহারাও মিলিয়ে নিতে হবে ফাইলের ছবির সঙ্গে।
ফাইলটা ঘাঁটছিল অনীশ। দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎ যেন দরজা বেয়ে আসা আলোটা আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। অনীশ তাকিয়ে দেখল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ভাইমার। তাকে দেখে ফাইল বন্ধ করে অনীশ বলল, আপনি কখন ফিরলেন?
ভাইমার বললেন, মানে?
অনীশ বলল, পাইনবনে যে আপনার সঙ্গে দেখা হল তারপর কখন ক্যাম্পে ফিরলেন?
ভাইমার একটু চুপ করে রইলেন। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট লাগছে তার মুখ। তিনি বললেন, ও, হা, বেশ কিছুক্ষণ হল।
জবাব দিয়ে ভাইমার ঘরের ভিতর ঢুকতে গিয়েও হঠাৎই থমকে গেলেন। বেশ কয়েকবার নাক টেনে ঘরের ভিতর তাকালেন তিনি। তার নজর গিয়ে থামল অনীশের খাটের ওপর পড়ে থাকা কাঠ গোলাপের বোকেটার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ফেলে দিন বোকেটা, এখনই জানলা দিয়ে ফেলে দিন। কারা দিল ওটা?
বিস্মিতভাবে অনীশ বলল, গ্রামবাসীরা। কেন কী হল?
ভাইমার দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বার করে নাক চাপা দিয়ে বলল, ওতে আমার ভয়ানক অ্যালার্জি। এখনই আমার হাত মুখ চুলকাতে শুরু করবে। প্লিজ ফেলে দিন ওটা।
অনীশ ব্যাপারটা এবার বুঝতে পেরে জানলা দিয়ে বোকেটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলল।
ঘরে ঢুকলেন ভাইমার। অনীশও খাট ছেড়ে নামল। মুখ থেকে রুমাল সরালেন ভাইমার। এর মধ্যেই তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। বিশেষ বিশেষ ফুলের গন্ধে অনেকেরই অ্যালার্জি হয়। অনীশের এক পরিচিত বন্ধুর কাঠালি-পা ফুলের গন্ধেও এমন অ্যালার্জি হত।
রুমাল সরিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন ভাইমার। তাই দেখে অনীশ বলল, আপনাকে বেশ চিন্তান্বিত লাগছে! কিছু হয়েছে?
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ। মাথায় চিন্তা ঘুরছে। ওপার থেকে তিব্বতী চীনাদের দলটার রসদ নিয়ে ভোরবেলাই পৌঁছোনোর কথা। তারা এখনও এল না। এদিকে আকাশের যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আজ সন্ধ্যা থেকেই ভারী তুষারপাত শুরু হবে। বরফে পাস আটকে গেলে তারা আর আসতে পারবে না। এদিকে রসদও শেষ। আমাদের কথা বাদ দিন প্রাণীগুলোকে তো খাবার দিতে হবে। আমার কর্মচারীরা তো বটেই প্রাণীগুলোও গত দুদিন ধরে না খেয়ে। আছে বলা চলে।
অনীশের বেশ লজ্জা লাগল ভাইমারের কথা শুনে। তাদের নিজেদের খাদ্য সংকট অথচ তারা দু-বেলা অনীশের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন বলে।
সে বলল, আমার খাবার নিয়ে কিন্তু আপনি ভাববেন না। সঙ্গে শুকনো খাবার আছে। প্রয়োজনে গ্রাম থেকে খাবার সংগ্রহ করে নেব।
ভাইমার মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, আসলে প্রাণীগুলোর ভবিষ্যতের চিন্তা সবসময় মাথায় ঘুরছে, তার ওপর আবার এই সমস্যা! মাথার ভিতর সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা কী বলল আমাকে আর একবার বলুন তো?
অনীশ বলল, ওই তো তখন আপনাকে যা বললাম। আপনার প্রস্তাব ওদের বললাম। ওরা ভাববে বলল, দেখা যাক কী হয়?
ভাইমার মৃদু চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে আপনার কী মনে হল? আমার ক্যাম্পের ওপর ওদের এত রাগ কেন?
অনীশ জবাব দিল, ওদের ধারণা আপনার ক্যাম্পের নেকড়েরা আসলে ওয়্যার উলফ।
আবারও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন ভাইমার। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে যে কত হত্যা করা হয়েছে তার হিসাব নেই। এখন এ সত্ত্বেও যদি সরকার এদেরকে সমর্থন করেন তবে আর কিছু বলার নেই।
ভাইমারের কথায় অনীশের মনে পড়ে গেল লেফটানেন্টের কথা। সে বলল, আপনি কখনও কাউকে মজা করেও বলেননি তো যে আপনার নেকড়েরা ওয়্যার উলফ??
ভাইমার বললেন, না, বলিনি। তবে আমার নাম করে কেউ যদি সে কথা ছড়িয়ে থাকে তবে তা আমি জানি না।