হোটেলেই ট্যাক্সি ছিল, একটা নিয়ে গুমতীর ব্রিজ পেরিয়ে জয়ন্তবাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। আজ বাড়িটাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল, বেশ বোঝা যাচ্ছিল ওখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
সুলেমান এসে দরজা খুলে দিল, আমরা তিনজন ভিতরে ঢুকলাম! জয়ন্তবাবু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বৈঠকখানায়, আমাদের দেখেই সোফা ছেড়ে উঠে এলেন।
ওটা পাওয়া গেল না, প্রথম কথাই বললেন ভদ্রলোক।
ফেলুদা বলল, সেটা অস্বাভাবিক নয়। আমারও মনে হয়েছিল ওটা পাওয়া যাবে না। যে নিয়েছে সে তো আর বোকা নয় যে হাতের কাছে রেখে দেবে জি
আপনিও কি আলাদা করে। সার্চ করতে চান?
না, বলল ফেলুদা? আমি আপনার বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। এখন এ বাড়িতে কে কে রয়েছেন?
আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে, ছেলে বোধহয় এখনও ফেরেনি। আর আছেন সোম-যার সঙ্গে কাল আপনাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম।
আমার কিন্তু মিঃ সালডানহার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। আর মিঃ সুকিয়াস।
সেটা কোনও অসুবিধা নেই। আমি আপনাকে ঠিকানা দিয়ে দেব, আপনি ফোনে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করে চলে যাবেন।
তা হলে আপনাকে দিয়ে শুরু করা যাক।
বেশ তো।
আমরা সকলেই সোফায় বসলাম।
একটু চা খাবেন তো? জয়ন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
তা খেতে পারি।
জয়ন্তবাবু সুলেমানকে ডেকে চার কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপর ফেলুদা একটা চারমিনার, ধরিয়ে তার প্রশ্ন শুরু করল।
আপনি বলছিলেন সুকিয়াস আপনার শাশুড়ির হারটা কিনতে চেয়েছিলেন। সেটা কতদিন আগে?
বছরখানেক হবে।
সুকিয়াস জানলেন কী করে এই হারের কথা?
এটার কথা অনেকেই জানে। এককালে খবরের কাগজে বেরিয়েছিল তো। আমার শাশুড়ি মারা যাবার পর তাঁর একটা সংক্ষিপ্ত জীবনী এখানকার পারোনিয়ার কাগজে বেরিয়েছিল। তাতে হারের কথাটা ছিল। সুকিয়াস এমনিতে মানিলেন্ডার, তেজারতির কারবার করে। ভাবলে মনে হয় এমন লোকের শিল্পের দিকে কোনও ঝোঁক থাকবে না। কিন্তু সুকিয়াস এ ব্যাপারে একটা বিরাট ব্যতিক্রম। আমি ওর বাড়িতে গিয়েছি, ওর সংগ্ৰহ দেখেছি। দেখবার মতো সব জিনিস আছে। ওর কাছে। ওর রুচি অনবদ্য।
আপনি যখন হারটা বিক্রি করলেন না, তখন ওর প্রতিক্রিয়া কী হয়?
ও খুবই হতাশ হয়েছিল। ও দু লাখ টাকা অফার করেছিল। আমি নিজে হলে কী করতাম জানি না, কিন্তু আমার স্ত্রী হারটার প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত। কোনও মতেই ওটা হাতছাড়া করবে না। আর সেই হারই…
জয়ন্তবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আপনি কাউকে সন্দেহ করেন এই ব্যাপারে?
আমি সম্পূর্ণ হতভম্ব। চাকর বাকর কাউকেই আমার সন্দেহ হয় না। ওরা বেইমানি করবে। এটা আমি বিশ্বাস করি না; অথচ তার বাইরে কে যে এটা নিতে পারে, এবং কেন, সেটা বোঝার সাধি; আমার নেই।
আপনি তো ব্যবসাদার, ফেলুদা বলল।
ব্যবসাদার মানে আমার একটি ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের আপিস আছে।
কেমন চলে আপিস?
ভালই। আমাদেরই কোম্পানি। আমার একজন পার্টনার আছে।
কী নাম?
ত্ৰিভুবন নাগর। এখানকারই লোক। আমার প্রথম জীবনে আমি ব্যবসায় ছিলাম না, একটা সওদাগরি আপিসে চাকরি করতাম। নগর ছিল আমার বন্ধু। ত্ৰিশ বছর আগে নাগর আর আমি মিলে আমাদের ব্যবসা শুরু করি।
আপনাদের কোম্পানির নাম কী?
মডার্ন ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট।
কোথায় আপনাদের আপিস?
হজরতগঞ্জে।
ইতিমধ্যে আমাদের চা এসে গেছে, আমরা খেতে শুরু করে দিয়েছি। ফেলুদা বলল, আরেকটা প্রশ্ন আছে।
কী?
কাল যখন ফিল্মটা চলছিল তখন আপনি কাউকে চলাফেরা করতে, কিংবা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন?
উঁহু।
আপনার ছেলে কোনও চাকরি করে?
এখনও না। ওকে আমার আপিসে ঢোকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও রাজি হয়নি।
ওর বয়স কত?
পঁচিশ।
ওর কোনদিকে ঝোঁক?
ঈশ্বর জানেন।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। একবার আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা যায় কি?
নিশ্চয়ই। ও খুবই ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছে, বুঝতেই পারেন।
আমি বেশি বিরক্ত করব না ওঁকে?
চা খাবার পর জয়ন্তবাবু গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ডেকে আনলেন। ভদ্রমহিলা কান্নাকাটি করেছেন সেটা এখনও দেখলে বোঝা যায়। দিনের বেলা দেখে আরও বেশি করে। মনে হল যে শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে এঁর আশ্চর্য চেহারার মিল। ভদ্রমহিলা চাপা গলায় বললেন, আপনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাইছিলেন…?
ফেলুদা বলল, হ্যাঁ। বেশিক্ষণ আপনাকে কষ্ট দেব না। সামান্য কয়েকটা প্রশ্ন।
বলুন।
আপনার মা যে হারটা আপনার দিদিকে না দিয়ে আপনাকে দিলেন তাতে আপনার দিদির কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
তিনি বোধহয় এ ব্যাপারটা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন।
কেন?
দিদি ছিল আমার বাবার ফেভারিট, আর আমি ছিলাম মা-র। মা মারা যাবার তিন বছর। আগে হারটা আমাকে দেন। দিদির মনের অবস্থা কী হয়েছিল বলতে পারব না, কারণ এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কখনও কোনও আলোচনা হয়নি।
আপনার দিদির সঙ্গে আপনার সদ্ভাব আছে?
হ্যাঁ। যত দিন যাচ্ছে। আমরা দুজনে তত আরও কাছাকাছি এসে পড়ছি। যখন ইয়াং ছিলাম তখন দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষির ভাব ছিল।
আপনি তো অভিনয় করতে খুব ভালবাসেন?
হ্যাঁ। তাই তো মা আমাকে নিয়ে এত প্রাউড় ছিলেন। এ ব্যাপারে দিদির কোনও শখ ছিল না।
আপনার মেয়ের?
শীলা স্কুলে কলেজে অ্যাকটিং করেছে, ক্লাবে-স্ট্রলাবেও দু-একবার করেছে। তার বেশি নয়; ও ফিল্মে অফার পেয়েছে, কিন্তু নেয়নি।