নিশ্চয়ই, বলল ফেলুদা। ইনি আমার কাজিন তপেশ মিত্র, আর ইনি আমার বন্ধু—বিখ্যাত লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী।
এই লেখকটিকে আপনি কতদিন হল চেনেন?
বছর পাঁচ-ছয়।
আমি লালমোহনবাবুর দিকে দেখছিলাম। ভদ্রলোক ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। আমি ওঁকে কণ্ঠহার চোর হিসেবে কল্পনা করলাম। এই সংকটের অবস্থাতেও আমার হাসি পেয়ে গেল।
এরার পাণ্ডে অন্য প্রশ্নে গেলেন।
এখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে কজন এ বাড়িতে থাকেন?
জয়ন্তবাবু বললেন, আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই ছেলেমেয়ে এবং আর্টিস্ট মিঃ সোম।
মিঃ সোম আজও দাড়ি কামাননি। তাই তাঁকে আরও অপরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।
আর সকলেই বাইরের লোক? পাণ্ডে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
মিঃ সালডানহা থাকেন ক্লাইভ রোডে। উনি আমার ব্রাদার-ইন-ল। ওঁর স্ত্রী আমার স্ত্রীর বড় বোন।
আরেকজনকে দেখছি, রতনলালের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন মিঃ পাণ্ডে।
উনি রতনলাল ব্যানার্জি-আমার স্ত্রীর ছোট ভাই।
এ ছাড়া আর কেউ ছিল?
একজন ছিলেন। লাটুশ রোডের মিঃ সুকিয়াস। উনি অবশ্য নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন না, এমনিই এসে পড়েন। তিনি এসেছিলেন যখন ফিল্মটা দেখানো হচ্ছে তার মাঝখানে। আলো জ্বালার পরে আমি তাঁকে দেখি।
এই সুকিয়াসের প্রেফেশন কী?
হি ইজ এ কালেক্টর অফ আর্ট অবজেক্টস। তা ছাড়া তেজারতির কারবার আছে।
ইনি কি এই হারটা সম্বন্ধে কোনওদিন ইন্টারেস্ট দেখিয়েছিলেন?
উনি ওটা কিনতে চেয়েছিলেন। আমরা বিক্রি করিনি।
আই সি
ইনস্পেক্টর পাণ্ডে একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে কাল এখানে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরই মধ্যে একজন হারটা নিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে, সেই হারটা কোথায়।
জয়ন্তবাবু গলা খাঁকরে নিয়ে বললেন, আপনি যদি সার্চ করতে চান তা হলে করতে পারেন। এমনকী ব্যক্তিগত খানাতল্লাশিতেও আপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।
পাণ্ডে বললেন, তা তো করতেই হবে। সার্চ থেকে মহিলারাও বাদ পড়বেন না। এবং তার জন্য আমি মেয়ে পুলিশের বন্দোবস্ত করছি। তা ছাড়া বাড়িটাও ভাল করে সার্চ করা দরকার।
সার্চের ব্যাপারে দেখলাম। কেউই আপত্তি করলেন না। খালি সালডানহা বললেন, আমার দোকান খুলতে হবে দশটার সময়। তার মধ্যে আমার সার্চটা হয়ে গেলে ভাল।
ফেলুদা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার বলল, এখানে সার্চ চলুক! আমি তা হলে এখন আসি। যদি হারটা পাওয়া যায় তা হলে আশা করি জয়ন্তবাবু আমাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন। না হলে আমি ও বেলা আবার আসব।
আমরা তিনজনে হোটেলে ফিরে এলাম। লালমোহনবাবুও আমাদের সঙ্গে আমাদের ঘরেই এলেন। ভদ্রলোক ঢুকেই বললেন, এ নিয়ে কবীর হল বলুন তো, যে আমরা বেড়াতে গিয়ে কেসে জড়িয়ে পড়েছি? এ জিনিস টেলিপ্যাথি ছাড়া হয় না।
ফেলুদা বলল, দেখি আপনার স্মরণশক্তি কতদূর। তোপ্সেকে তো এর আগে অনেকবার পরীক্ষা করেছি, আপনাকে কখনও করা হয়নি।
ভেরি ওয়েল স্যার, আই অ্যাম রেডি, বললেন জটায়ু।
আগে শকুন্তলা দেবীর ফ্যামিলি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি।
করুন।
ভদ্রমহিলার তিন সন্তানের নাম বলুন তো।
বড় মেয়ে সুশীলা–
তার আগে একটা ক্রিশ্চান নাম আছে।
ও হ্যাঁ-ক্রিশ্চান নাম…ক্রিশ্চান নাম…
তোপ্সে বলতে পারিস?
আমার মনে ছিল। বললাম, মার্গারেট।
ভেরি গুড। তার পরের মেয়ে, অৰ্থাৎ জয়ন্তবাবুর স্ত্রী? এই প্রশ্নটা কিন্তু লালমোহনবাবুকে করছি।
লালমোহনবাবু এটা ভোলেননি। বললেন, প্যামেলা সুনীলা।
গুড। তাঁর পরের ভাই?
ইয়ে–রতনলাল। অ্যালবার্ট রতনলাল।
এবার সুশীলা দেবীর স্বামীর নাম?
স্যামুয়েল সালডানহা।
ভেরি গুড! সুনীলা দেবীর ছেলেমেয়ে?
মেয়ে শীলা-মেরি শীলা। আর ছেলে প্রসেনজিৎ। ক্ৰিশ্চন নাম ভুলে গেছি।
ভিক্টর। আর কে ছিলেন কাল পার্টিতে?
সেই আটিস্ট ভদ্রলোক। নামটা মনে পড়ছে না।
তোপ্সে?
সোম। সুদৰ্শন সোম।
গুড।
কিছু মাইন্ড করবেন না মশাই, লালমোহনবাবু বললেন, ভদ্রলোককে কিন্তু আমার ভাল লাগল না।
কেন?
কীরকম পাগলাটে চেহারা। দাড়ি কামাননি।
আর্টিস্টরা সব সময় সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলে না।
তা হতে পারে। মোট কথা, উনি আর আরেকজন আমার কাছে এই চুরির ব্যাপারে প্ৰাইম সাসপেক্টস।
আরেকজন কে?
জয়ন্তবাবুর ছেলে প্ৰসেনজিৎ? একেবারে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বাউণ্ডুলেদের মতো চেহারা। অবশ্য মদ তো দেখলাম খায় না ছেলেটি।
খেলেও হয়তো বাপের সামনে খায় না।
এনিওয়ে, পার্টিতে কিন্তু আরেকজন ছিলেন।
মিঃ সুকিয়াস তো?
হ্যাঁ। এর কিন্তু হারটার উপর লোভ ছিল।
যে কোনও আর্ট কালেক্টরেরই থাকবে। সেটা কিছুই আশ্চর্য না। আর্ট কালেক্টর হলে কিনতে চাইবে। আর অভাবী লোক হলে হাতাতে চাইবে। এঁদের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে আমরা কোনও কিছুই জানি না। কাজেই এখন অন্ধকারে হাতড়ে লাভ নেই। বিকেলে জয়ন্তবাবু ফোন করবেন, তার আগে পর্যন্ত আমরা ফ্রি। চলুন, আপনাকে কাইজার-বাগটা দেখিয়ে আনি।
ভেরি গুড আইডিয়া, বললেন লালমোহনবাবু। তদন্তের চাপে যদি লখ্নৌ শহরটা দেখা সম্পূর্ণ না হয় তা হলে খুব আপশোস থেকে যাবে।
০৫. পুলিশ সার্চ করে কিছু পায়নি
বিকেলে কথামতো জয়ন্তবাবু ফোন করলেন। পুলিশ সার্চ করে কিছু পায়নি। বাড়ির চাকরীদের জেরা করা হয়েছে, তাতেও কোনও ফল হয়নি। ফেলুদা বলল, চল, এবার একবার জয়ন্তবাবুর বাড়ি যাওয়া যাক। এবার ফেলুমিত্তিরের কাজ শুরু। অবিশ্যি পুলিশ তাদের তদন্ত চালিয়েই যাবে, কিন্তু তাতে আমাদের কিছু এসে যাচ্ছে না।