ভদ্রলোক বললেন, আমার শাশুড়ির নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন। উনি সাইলেন্ট যুগে ফিল্মে অ্যাকটিং করতেন। খুব পপুলার ছিলেন।
কী নাম বলুন তো? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
শকুন্তলা দেবী।
আরেব্বাস, বললেন লালমোহনবাবু, তিনি তো যাকে বলে তখনকার দিনে একজন বিখ্যাত স্টার। আমার এক প্রতিবেশী আছেন, নরেশ বোস—এখন বয়স হয়েছে, তবে যুবা বয়সে তিনি ফিল্মের পোকা ছিলেন। তাঁর কাছে বাঁধানো বায়োস্কোপ পত্রিকা দেখেছি। তাতে শকুন্তলা দেবীর বিস্তর ছবি রয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে লেখাও রয়েছে অনেক। তিনি বোধহয় বাঙালি ছিলেন না।
না। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলতে পারেন। আসল নাম ছিল ভার্জিনিয়া রেনল্ডস। তাঁর বাবা টমাস রেনল্ডস ছিলেন আর্মিতে। তিনি লখ্নৌতেই পোস্টেড ছিলেন। চোস্ত উর্দু বলতে পারতেন। তিনি একজন মুসলমান বাঈজিকে বিয়ে করেন। তাঁরই মেয়ে হলেন ভার্জিনিয়া।
হাইলি ইন্টারেস্টিং, বললেন লালমোহনবাবু। কিন্তু তিনি তো বোধহয় টকিতে অভিনয় করেননি।
না। এদেশে টকি আসার আগেই তিনি বিয়ে করে ফেলেন একজন বাঙালি ক্রিশ্চানকে। তারপর প্রথম সন্তান হবার পরই শকুন্তলা দেবী ছবির কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম দুটি সন্তান ছিল মেয়ে, তৃতীয়টি ছেলে। আমি দ্বিতীয় মেয়েকে বিয়ে করি। ১৯৬০-এ। আমার বড় শালি বিয়ে করেন একটি গোয়ানকে। আমার ছোট শালা বিয়ে করেননি।
এতদিন লখ্নৌতে থাকবার জন্যই বোধহয় ভদ্রলোকের বাংলায় একটা পশ্চিমা টান এসে গেছে। যদিও ভাষায় কোনও গণ্ডগোল নেই।
এবার ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল।
কোনও এক মহারাজা শকুন্তলা দেবীকে একটা মূল্যবান উপহার দিয়েছিলেন, তাই না?
আপনি ঠিকই বলেছেন, বললেন জয়ন্তবাবু। মাইসোরের মহারাজা! শকুন্তলার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে একটি বহুমূল্য কণ্ঠহার উপহার দেন। তখনকার দিনেই দাম ছিল। লাখ খানেকের মতো। কিন্তু এটা আপনি কী করে জানলেন? যদ্দুর মনে হয় শকুন্তলা অভিনয় করতেন। আপনার জন্মের আগে।
তা তো বটেই, বলল ফেলুদা। কিন্তু বছর পনেরো আগে আমি খবরের কাগজে একটা খবর পড়ি। এই হার চুরি হয়েছিল, তারপর পুলিশ সেটা উদ্ধার করে।
ঠিক কথা। তখনও শকুন্তলা দেবী বেঁচে। তিনি মারা গেছেন তিন বছর আগে আটাত্তর বছর বয়সে। মারা যাবার পরেও এই হারটার কথা কাগজে বেরিয়েছিল। কিন্তু আপনার সেই পনেরো বছর আগের খবরের কথা মনে আছে—আপনার মেমরি তো খুব শার্প দেখছি।
ক্রাইমের খবর আমি বহুদিন থেকেই খুব উৎসাহ নিয়ে পড়ি। আর পড়লে আমার মনেও থাকে। আসল কথাটা আপনাকে বলেই ফেলি। আমার পেশাটিও হচ্ছে ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত।
ফেলুদা পকেট থেকে তার একটা কার্ড বার করে জয়ন্তবাবুর হাতে দিল। ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল।
প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর! তাই বলুন। আপনার নামটা চেনা চেনা লাগিছিল। আপনার তো একটা ডাকনামও আছে।
হ্যাঁ। ফেলু।
ফেলু। ইয়েস–ফেলুদা! আমার মেয়ে আপনার বিশেষ ভক্ত। আপনার সব অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী তার পড়া। বাংলা সে এমনিতে একেবারেই পড়ে না, কিন্তু আপনার বইগুলো পড়ে। যাক, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল।
এবার ফেলুদা লালমোহনবাবুর পরিচয়টাও দিয়ে দিল। বলল, এঁর নাম লখ্নৌ অবধি পৌঁছেছে কি না জানি না, তবে ইনি বাংলার একজন বিশেষ জনপ্রিয় থ্রিলার রাইটার। জটায়ু ছদ্মনামে এর উপন্যাস বেরোয়।
বাঃ দুজন বিখ্যাত লোকের সঙ্গে ট্রেনের কামরায় আলাপ হয়ে গেল এ তো আশ্চর্য ব্যাপার। লখ্নৌতে আপনারা উঠছেন কোথায়?
ক্লার্কস-আওয়ধ।
আমি থাকি নদীর ওদিকে–বাদশাবাগে। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। একদিন আমাদের বাড়িতে খেতে আসতে হবে আপনাদের। আমার স্ত্রী খুব ভাল মোগলাই রান্না রাঁধেন। তা ছাড়া আমার মেয়ে তো ফেলুদাকে দেখে থ্রিলাড হয়ে যাবে। আপনাদের তিনজনেরই আসা চাই কিন্তু।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, বলল ফেলুদা। আর সেই সঙ্গে আশা করি বিখ্যাত কণ্ঠহারটাও একবার দেখা যাবে।
সে তো খুব সহজ ব্যাপার। কারণ হারটা আমার কাছেই আছে। অর্থাৎ আমার স্ত্রীর কাছে।
কেন? ছোট মেয়ের কাছে কেন? বড় মেয়ের কাছে নয় কেন?
কারণ ভার্জিনিয়ার তাঁর ছোট মেয়ের উপর বেশি টান ছিল। আর অনেক গুণ ছিল এই ছাট মেয়ের—অর্থাৎ আমার স্ত্রী সুনীলার। অবিশ্যি সে সব গুণের সদ্ব্যবহার সে করেনি। বিয়ের পর পুরো গৃহিণী বনে গিয়েছিল। বিয়ে না করলে হয়তো ফিল্মে চান্স নিত, কারণ তার অভিনয় দক্ষতা ছিল যথেষ্ট।
আপনার স্ত্রীর নাম সুনীলা বললেন। ওঁনার কোনও ক্ৰিশ্চন নাম নেই?
হ্যাঁ। ওর পুরো নাম প্যামেলা সুনীলা।
০২. লাঞ্চ খাব প্রতাপগড়ে
রাত্রে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে সাড়ে ছটায় উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে বক্সারে ব্রেকফাস্ট খেলাম। মোগলসরাই আসবে পৌনে নটায়। লাঞ্চ খাব প্রতাপগড়ে সাড়ে বারোটার সময়।
জয়ন্তবাবু দেখলাম খুব সকালেই ওঠেন। ব্রেকফাস্ট খেয়ে বললেন, কাছেই কুপেতে আমার এক চেনা ভদ্রলোক রয়েছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।
লালমোহনবাবুও স্নানটান করে দাড়ি কামিয়ে একেবারে ফিটফট। উনি বিক রেজার দিয়ে দাড়ি কামান। এগুলো বার তিন-চার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়। কলকাতায় পাওয়া যায় না। লালমোহনবাবুর এক বন্ধু কাঠমাণ্ডু থেকে ওঁর জন্য চার প্যাকেট অর্থাৎ কুড়িটা এনে দিয়েছেন। বললেন, ভারী আরামে শেভ করা যায় মশাই।