বোঝাই যাচ্ছে খুনটা কোনও ভদ্রলোক করেননি।
ফেলুদা প্রায় আপনমনেই কথাটা বলল। তারপর বলল, যতদূর মনে হয় এ হল লখ্নৌইয়া ভাড়াটে গুণ্ডার কাজ। আর এখানে ডাকাতির কোনও প্রশ্ন আসছে না, কারণ এই একটা ঘরেই অন্তত লাখ টাকার জিনিস রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শয়তানটিকে কিনি এমপ্লয় করেছিলেন। অর্থাৎ লোকটি কার অ্যাকমপ্লিস।
সেটা অবশ্য মিঃ সুকিয়াসের ব্যক্তিগত ইতিহাস না জানলে বোঝা যাবে না, বললেন লালমোহনবাবু। তাই নয় কি?
ফেলুদা বলল, ভদ্রলোকের বিষয় যে আমরা একেবারেই কিছু জানি না তা নয়। অদ্ভুত লোক ছিলেন সেটা তো জানি। চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার সঙ্গে উঁচু দরের শিল্পদ্রব্যের সংগ্রহ গড়ে তোলা সাধারণ লোকের কৰ্ম্ম নয়। আমার ধারণা চিঠিতেও কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।
সেটা একবার পড়বেন না? লালমোহনবাবুজিজ্ঞেস করলেন।
চিঠিটার উপরে কনফিডেনশিয়াল লেখা ছিল সেটা বোধহয় আপনি দেখেননি। ওটা পড়ব যথাস্থানে যথা সময়ে। আততায়ীকে সুকিয়াস দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। কাজেই তার আইডেনটিটি তো আর চিঠিতে থাকবে না।
দশ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে গেল। আবার ইনস্পেক্টর পাণ্ডে। ফেলুদার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, আপনি তো আমাদের টেক্কা দিয়েছেন দেখছি।
তা দিয়েছি, কিন্তু এখন থেকে এ কেসের ভার সম্পূর্ণ। আপনাদের উপর। আমি আর এতে নাক গলাতে চাই না, কারণ তাতে কোনও লাভ হবে না। শুধু আততায়ীকে ধরলে পরে আমাকে একটা খবর দেবেন।
আপনি তার মানে চললেন?
হ্যাঁ। তবে আপনার সঙ্গে হয়তো দু-এক’দিনের মধ্যেই আবার দেখা হবে। কারণ আমি সেই চুরির মামলাটা মোটামুটি সলভ করে এনেছি।
বলেন কী!
তই তো মনে হচ্ছে।
আমরা কিন্তু মিঃ বিশ্বাসের ছেলেকে সন্দেহ করছি। আপনিও কি তাই?
সেটা এখনও বলতে পারছি না। আমায় মাপ করবেন।
আমরা ডেফিনিট প্রুফ পেয়েছি ও ড্রাগসের খপ্পরে পড়েছে। ওর পিছনে একজন লোকও লাগিয়ে দিচ্ছি আমরা।
ওয়েল, বেস্ট অফ লাক। এখন তো আপনাদের হাতে আরেকটি ক্রাইম পড়ল। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন আছে। গুণ্ডা লাগিয়ে খুন। সবখানেই সম্ভব এবং সেটা লখ্নৌতেও সম্ভব বোধহয়।
খুব বেশি মাত্রায়।
থ্যাঙ্কস।
০৯. অর্ধেক মামলার সমাধান
কোনও একটা মামলার মাঝখানে ফেলুদাকে এত নিষ্কর্মা হয়ে পড়তে দেখিনি কখনও। আমরা পর পর দুদিন লালমোহনবাবুকে নিয়ে লখ্নৌ শহর দেখিয়ে বেড়ালাম। আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম, ফেলুদা, কী ব্যাপার বলে তো? তুমি এত চুপচাপ বসে আছ কেন?
ফেলুদা বলল, অর্ধেক মামলার সমাধান হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেক পুলিশের সাহায্য ছাড়া হবে না। আমি এর মধ্যে পাণ্ডের কাছ থেকে দুবার ফোন পেয়েছি। মনে হয় পাকা খবর আর দুদিনের মধ্যেই পেয়ে যাব।
পুলিশের ব্যাপারটা কি সুকিয়াসের খুনের সঙ্গে জড়িত?
ইয়েস, বলল ফেলুদা।
আর হার চুরি?
সেটা নিয়ে আর ভাববার কিছু নেই।
আর সুকিয়াসের খুন সম্বন্ধে তোমার কি কোনও ধারণাই নেই?
আছে, কিন্তু প্রমাণ চাই? সেই প্রমাণটা পুলিশ গুণ্ডাটাকে ধরতে পারলেই পেয়ে যাব। কে খুন করিয়েছে সে সম্বন্ধে আমার একটা পরিষ্কার ধারণা আছে।
আরও একটা দিন এই ভাবে কেটে গেল। আমরা জটায়ুকে নিয়ে মিউজিয়াম দেখিয়ে আনলাম। এখন জটায়ুর লখ্নৌ দেখা শেষ বললেই চলে। আমাদের কলকাতায় ফিরতে আর দুদিন বাকি আছে।
দুপুরবেলা ফেলুদা যে ফোনটা আশা করছিল সেটা এল। মিঃ পাণ্ডের কাছ থেকে। কথা বলার পর ওকে জিজ্ঞেস করতে ফেলুদা বলল, কেস খতম। ওরা গুণ্ডাটাকে ধরেছে। শম্ভু সিং বলে এক পাঞ্জাবি। সে আদালতে দোষ স্বীকার করেছে, আসল লোককে দেখিয়ে দেবে বলেছে। যে ছুরিটা দিয়ে খুনটা করা হয়েছিল সেটাও পাওয়া গেছে।
তা হলে এখন কী হবে?
রহস্য উদঘাটন। আজি সন্ধ্যা সাতটায় জয়ন্ত বিশ্বাসের বাড়িতে।
এর পর ফেলুদাকে পর পর অনেকগুলো ফোন করতে হল। প্ৰথমে অবশ্য জয়ন্তবাবুকে। ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, বাকি সবাইকে তা হলে আপনিই খবর দিয়ে দিন। আপনি তো সকলের টেলিফোন নম্বরই জানেন।
ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে পৌনে সাতটার সময় হেক্টর জয়ন্ত বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। ইনস্পেক্টর পাণ্ডেও এসে পড়লেন সাতটার পাঁচ মিনিট আগে-সঙ্গে দুজন কনস্টেবল, আর আরেকটি লোক যার হাতে হাতকড়া। বুঝলাম সেই হচ্ছে খুনি গুণ্ডা।
সাতটা বেজে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সকলে এসে পড়ল। সকলে বলতে তালিকাটা দিয়ে দিই—জয়ন্তবাবুর বাড়ির পাঁচজন, সাল্ডান্হার বাড়ির দুজন আর রতনলাল ব্যানার্জি। প্রশস্ত বৈঠকখানায় সকলে চেয়ার আর সোফাতে ছড়িয়ে বসলেন। রতনলাল আগেই প্রশ্ন করলেন, হোয়াট ইজ দিস ফার্স? ফেলুদা বলল, আপনি এটাকে প্রহসন বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু আর সকলের কাছে ব্যাপারটা বোধহয় খুবই সিরিয়াস।
হারটা পাওয়া গেছে কি? চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন সুনীলা দেবী।
যথাসময়েই তার উত্তর পাবেন, বলল ফেলুদা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত সকলের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, রহস্যের সমাধান হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এটা পুলিশের সাহায্য ছাড়া হত না। আমি আপনাদের এখন ঘটনাটা বলতে চাই। আশা করি আপনাদের মনে যে সমস্ত প্রশ্ন রয়েছে তার জবাবও আমার কথায় পেয়ে যাবেন।
আই হাপ খুব বেশি সময় নেবেন না, বললেন রতনলাল ব্যানার্জি, আমার একটা ডিনার আছে।