হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের ঘরে শীলা বসে আছে, তার হাতে অটোগ্রাফ খাতা। আমাদের দেখে শীলা উঠে পড়ল। বলল, আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করে গেলাম। এনিওয়ে, সইয়ের জন্য ধন্যবাদ। আশা করি আপনার ডিটেকশন সফল হবে।
শীলা চলে গেলে পর লালমোহনবাবুকেই বলতে দিলাম ফেলুদাকে দিলখুশার ঘটনাটা। ফেলুদা সব শুনে বলল, আমার ওর চোখের চাহনি দেখেই সন্দেহ হয়েছিল ও ড্রাগ ব্যবহার করে; ও ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কিন্তু তা হলে ওই কি কণ্ঠহার চোর? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ফেলুদা কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, ভাল কথা, আপনাদের আরেকবার একটু বেরোতে হবে।
হোয়াই স্যার?
সুকিয়াসের টেলিফোন খারাপ। অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়নি। আমিই বেরোতাম, কিন্তু শীলা এসে পড়ল। ওঁর বাড়িতে গিয়ে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করতে হবে। চট করে বেরিয়ে পড়লে এখনও ওঁকে বাড়িতে পাবার চান্স। আমার মাথায় একটা জিনিস দানা বাঁধছে। তাই আমি বেরোতে চাচ্ছি না। যা তোপ্সে, ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়।
লালমোহনবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, জেরা শুনতে শুনতে প্ৰাণ হাঁপিয়ে উঠছিল, এবার তবু একটা কাজ পাওয়া গেল।
আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। সাত নম্বর লাটুশ রোড বলতেই ট্যাক্সি আমাদের সোজা। গন্তব্যস্থলে নিয়ে গেল। আমরা ট্যাক্সিটাকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বললাম।
বেশ বড় একতলা বাড়ি, গেটের গায়ে মার্কল ফলকে লেখা এস সুকিয়াস। গেট দিয়ে ঢুকে দুদিকে বাগান। তাতে ফুল নানা রকমের। বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ গাড়িবারান্দায় পৌঁছেছে। বাড়ির বয়স অন্তত পঞ্চাশ বছর তো হবেই।
আমরা কলিং বেল টিপতে একজন বেয়ারা এসে দরজা খুলে দিল।
লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ সুকিয়াস হ্যায়?
জি হাঁ হুজুর—আপকা সুভনাম?
জারা বোলিয়ে মিঃ মিটারকে পাস সে দো আদমি আয়ো হাঁয় এক মিনিট বাৎচিৎকে লিয়ে।
হিন্দিতে কটা ভুল হল জানি না, কিন্তু বেয়ারা ব্যাপারটা বুঝে নিল। আমাদের এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলে সে ভিতরে চলে গেল।
এক মিনিট পরে যে বেয়ারা বেরিয়ে এল। তার চেহারাই পালটে গেছে। দৃষ্টি বিস্ফারিত, হাত পা ঠক ঠক করে কাঁপছে, মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না।
কেয়া হুয়া? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
আপলোগ… অন্দর আইয়ে… কোনওরকমে বলল বেয়ারা। আমরা বেয়ারার পিছন পিছন ভিতরে ঢুকলাম। বেয়ারা সেইভাবেই কাঁপতে কাঁপতে বৈঠকখানা পেরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ঢোকাল আমাদের।
ঘরটা হল যাকে বলে স্টাডি। চারিদিকে নানারকম শিল্পদ্রব্য আর বইয়ে ঠাসা আলমারি। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার পিছনে একটা রিভলভিং চেয়ার। সেই চেয়ারে বসে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন মিঃ সুকিয়াস, পরনে সাদা শার্ট, তার পিঠ রক্তে লাল। এরকম বীভৎস দৃশ্য আমি কমই দেখেছি।
কী হরিবল ব্যাপার! বললেন লালমোহনবাবু। তারপর বেয়ারার দিকে ফিরে বললেন, তুমি শেষ কখন দেখেছ তোমার মনিবকে?
বেয়ারা আমতা আমতা করে যা বলল তাতে বুঝলাম মিঃ সুকিয়াস সকালে ব্রেকফাস্ট করে এই ঘরে চলে আসেন কাজ করতে। তিনি নিজেই সব করেন, তাঁর সেক্রেটারি নেই, বা বাড়িতে অন্য কোনও লোক নেই। বেয়ারা এই সময়টা প্রয়োজন না হলে তাঁকে ডিসটার্ব করে না। আজও সেই একই নিয়ম মানা হয়েছে।
সকলে কোনও লোক ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
বেয়ারা মাথা নাড়ল।
নেহি হুজুর। কোই নেহি আয়া।
আমি বুঝতেই পারছিলাম যে বাইরে থেকে সামনের দরজা দিয়ে লোক আসার কোনও দরকার নেই, কারণ সুকিয়াসের চেয়ারের পিছনেই হাট করে খোলা একটা জানালা, তাতে শিকা নেই। খুনি যে সেই জানালা দিয়েই ঢুকেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তোমাদের টেলিফোন তো খারাপ, তাই না? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
হাঁ হুজুর-দো রোজসে খারাপ হ্যায়।
কিন্তু–
আমি বললাম, পুলিশের কথা ভুলে গিয়ে চলুন ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়ে ফেলুদাকে নিয়ে আসি; যা করার ওই করবে।
তই চলো।
০৮. ভুরু ভীষণ কুঁচকে গেছে
আমরা দশ মিনিটে হোটেলে পৌঁছে গেলাম।
ফেলুদাকে খবরটা দিতেই সে তার খাতাটা ফেলে দিয়ে কোনও কিছু না বলে জ্যাকেটটা চাপিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার ভুরু ভীষণ কুঁচকে গেছে।
সুকিয়াসের বাড়ি পৌঁছে সে প্রথমেই বেয়ারকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের ড্রাইভার আছে?
হ্যায় হুজুর, গাড়ি ভি হ্যায়।
ড্রাইভারকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
ড্রাইভার আসতে ফেলুদা তাকে তৎক্ষণাৎ থানায় খবর দিতে বলল। ডুইভার চলে গেল।
এবার আমরা গিয়ে স্টাডিতে ঢুকলাম।
ছুরি মেরেছে ভদ্রলোককে, বলল ফেলুদা, অস্ত্রটা নিয়ে গেছে।
তারপর টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ভদ্রলোক চিঠি লিখছিলেন।
সেটা অবশ্য আমিও দেখেছিলাম। ইংরিজি চিঠির বেশ খানিকটা লেখা হয়ে গেছিল যখন ছুরিটা মারে।
এ কী–এ যে আমাকেই লেখা চিঠি? বলে উঠল ফেলুদা। তারপর বলল, যদিও পুলিশ আসার আগে এখানে কিছু নড়াচড় করা উচিত না, চিঠিটা যখন আমার তখন সেটার উপর আমার নিশ্চয়ই একটা ক্লেম আছে।
এই বলে ফেলুদা চিঠিটা প্যাড থেকে ছিঁড়ে ভাঁজ করে পকেটে পুরে নিল।
তারপর জানালার কাছে গিয়ে বাইরে ঝুঁকে দেখল। জানালার বাইরে একটা হাত চারেক চওড়া প্যাসেজ, তার পরেই বাড়ির পাঁচিল। সেই পাঁচিল টপকে লোক আসা খুব কঠিন নয়।