ভদ্রলোক আমাদের দেখে স্টিরিওটা বন্ধ করে বললেন, কী ব্যাপার?
ফেলুদা বলল, কালকে চুরির ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। আমরা সকলকেই করেছি।
এভরিওয়ান?
শুধু মিঃ সুকিয়াসকে বাকি। সেটা কাল করব।
আপনার কি ধারণা আমি চুরিটা করে থাকতে পারি?
মোটেই না। তবে চোর ধরতে আপনি সাহায্য করতে পারেন।
আই অ্যাম নট ইন দ্য লিস্ট বিট ইন্টারেস্টেড ইন দ্য থেফট।
এত দামি আর ভাল একটা জিনিস চুরি হল, আর তাতে আপনার ইন্টারেস্ট নেই?
মাইসোরের দেওয়া জিনিস তো দামি হবেই, তাতে আশ্চর্যের কী আছে?
আপনার মা-র এত সাধের জিনিস ছিল!
আমার মা-র ফিল্ম কেরিয়ার সম্বন্ধেও আমার কিছুমাত্র উৎসাহ নেই। আই থিংক অল ফিল্মস আর রটন। সাইলেন্ট ফিল্মস তো বটেই।
আপনার পেশাটা কী জানতে পারি?
তা পারেন। আমি একটা মার্কেনটাইল ফর্মের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।
তা হলে আপনি আর কোনওরকমে সাহায্য করতে পারছেন না আমাদের?
আই অ্যাম ভেরি সরি। আমার কিছু বলার নেই।
একটা শেষ প্রশ্ন আছে।
কী?
কাল ফিল্মটা চলার সময় আপনি কাউকে জায়গা পরিবর্তন করতে দেখেছিলেন?
আমি তো ফিল্ম দেখছিলাম না। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। আই স মিঃ সুকিয়াস কাম ইন।
ধন্যবাদ। আপনি দেখছি আপনার পিতামহের মতো হিন্দি গানের ভক্ত।
রতনলাল কোনও মন্তব্য না করে আবার স্টিরিওটা চালিয়ে দিলেন। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
০৭. দিলখুশা
পরদিন সকালে ফেলুদা বলল, তোরা বরং দিলখুশাটা দেখে আয়। আমার একটু চিন্তা করার আছে, তা ছাড়া দু-একটা টেলিফোন করারও আছে। সুকিয়াসের সঙ্গে একটা অ্যািপয়েন্টমেন্ট করতে হবে। ইনস্পেক্টর পাণ্ডেকেও একটা ফোন করব।
আমরা দুজনে আজ ট্যাক্সির বদলে একটা টাঙ্গা নিয়ে বেরেলাম। লালমোহনবাবুর ভীষণ শাখ টাঙ্গা চড়ার কারণ উনি জানেন বাদশাহী আংটির সময় আমরা টাঙ্গা চড়েছিলাম।
টাঙ্গ রওনা হবার পর লালমোহনবাবু বললেন, দিলখুশার ইতিহাসটা একটু জেনে নিই।
আমি বললাম, দিলখুশা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নবাব সাদাত আলির তৈরি একটা বাগানবাড়ি ছিল। এর আশেপাশে হরিণ চরে বেড়াত। এখন শুধু ব্যাপারটার ভগ্নাবশেষ রয়েছে, তবে তার পাশে একটা সুন্দর পার্ক রয়েছে যেখানে লোকে বেড়াতে যায়। দিলখুশার উত্তরে বিখ্যাত লা মার্টিনিয়ার ইস্কুল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্লড মার্টিনের তৈরি। মার্টিন ছিলেন মেজর জেনারেল। দিলখুশা থেকে এই স্কুলটা দেখতে পাবেন।
টাঙ্গাতে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল—সত্যি, লখ্নৌ-এর মতো বাহারের শহর ভারতবর্ষে কমই আছে। লালমোহনবাবু অবশ্য বার বারই বলছেন, ইতিহাস চোখের সামনের দেখতে পাচ্ছি।
দিলখুশার ভগ্নাবশেষ দেখতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমরা সে কাজটা শেষ করে পাৰ্কটায় একটু বেড়াতে গেলাম, আর সেখানে গিয়েই একটা বিশ্ৰী ঘটনায় আমাদের জড়িয়ে পড়তে হল।
প্ৰথমে মনে হয়েছিল পার্কে কোনও লোকজন নেই। লোক সচরাচর হয় বিকেলের দিকে। আমরা ফুলবাগানের মধ্যে দিয়ে খানিকদূর হাঁটার পর একটা গাছের পিছনে একটা বেঞ্চির খানিকটা অংশ দেখলাম, আর সেই সঙ্গে মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম। গাছটা পেরোতেই যে দৃশ্যটা দেখলাম তাতে আমাদের বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করে উঠল।
দেখি কী, প্রসেনজিৎ আর দুটি তারই ধাঁচের ছেলে বেঞ্চিতে বসে কী যেন খাচ্ছে। তিনজনেরই চুল উসকো খুসকো আর চোখ ঘোলাটে। ওরা যে নেশা করছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই, আর এই নেশা বড় সহজ নেশা নয়। এ হল ড্রাগের ব্যাপার, যা খেয়ে মানুষ সম্পূর্ণ হঁশ হারিয়ে খুন পর্যন্ত করতে পারে।
প্রসেনজিৎ এত মশগুল ছিল যে সে আমাদের প্রথমে দেখতেই পায়নি। তারপর যখন দেখল তখন তার মুখে এক অদ্ভুত ক্রুর হাসি ফুটে উঠল।
ডিটেকটিভের চেলাদের দেখছি, ডিটেকটিভূ কোথায়? প্রশ্ন করল সে জড়ানো গলায়।
তিনি আসেননি, বললেন লালমোহনবাবু।
আহা, এমন একটা দৃশ্য দেখতে পেলেন না।
আমরা চুপ।
চোর ধরা পড়ল? বিদ্যুপের সুরে প্রশ্ন করল প্রসেনজিৎ।
এখনও পড়েনি।
আমাকেই তো সকলে সন্দেহ করছে, তাই না? কারণ আমার টাকার অভাব। লোকের কাছে ধার চাইতে হয় ঘণ্টাখানেক স্বৰ্গবাসের জন্য। শুনুন-আই ক্যান টেল ইউ দিস-হার চুরি করার মতো বাকা আমি নই। আমার লাক্ খুলে গেছে। আমি বেশির ভাগ টাকা পাই জুয়া খেলে। মাঝে মাঝে লোকের কাছে ধার করতে হয়, কারণ এ জিনিস একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না। আপনি ধরলে আপনিও আর ছাড়তে পারতেন না, মিস্টার থ্রিলার রাইটার। একবার ট্রাই করে দেখুন না—আপনার লেখা অনেক ইমপ্রুভ করে যাবে। মাথার মধ্যে গল্পের প্লট ভিড় করে আসবে। কী, মিস্টার রাইটার—কী বলেন?
আমরা দুজনেই নিবাঁক। এরকম একটা দৃশ্যের সামনে পড়তে হবে ভাবতেই পারিনি।
তবে একটা কথা বলে রাখি। —হঠাৎ তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে খসখসে ধারালো গলায় বলল প্রসেনজিৎ। তারপর তার জীনসের পকেট থেকে একটা ফ্রিক নাইফ বার করে খ্যাঁচ করে বোতাম টিপে ফলাটা বার করে সেটা আমাদের দিকে বাড়িয়ে বলল, আজকের কথা যদি ঘূণাক্ষরেও কেউ জানতে পারে তা হলে বুঝব সেটা আপনাদের কীর্তি। তখন বুঝবেন এই ছুরির ধার কত। নাউ ক্লিয়ার আউট ফ্রম হিয়ার!
বেগতিক ব্যাপার। এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়, আর কোনও প্রয়োজনও নেই। যা দেখার তা দেখে নিয়েছি, আর এ দৃশ্য শুধু আমরাই দেখেছি, আর কেউ দেখেনি। আমরা দুজনে আবার টাঙ্গা করে হোটেলে ফিরে এলাম। সারা পথ দুজনের মুখে একটিও কথা নেই।