কী বুঝলেন? জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
ফেলুদা বলল, অন্তত ছটা প্রাণদণ্ড সম্পর্কে উনি নিশ্চিত যে সেগুলো অন্যায়ভাবে দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলোতে তিনি ভুল করেছেন। এই ছটা কেসেই কারাদণ্ড দেওয়া উচিত ছিল। একটি বিশেষ কেস-সেখানে আবার আসামি হচ্ছেন কাশ্মীরি, নাম সঙ্গু–সেখানে ফাঁসির হুকুম দেওয়ার পরে মল্লিকের খুব অনুশোচনা হয়। তারপরেই অবিশ্যি ওঁর অ্যানজাইনার পেইন আরম্ভ হয় এবং উনি কিছু দিনের মধ্যে রিটায়ার করেন।
পাহালগাম শ্ৰীনগর থেকে ষাট মাইল। লিন্দার উপত্যকায় ছোট্ট শহর। এক পাশ দিয়ে খরস্রোতা লিদর নদী বয়ে গেছে। তাতে সাহেবরা ট্রাউন্ট মাছ ধরে। শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে বরফের পাহাড় দেখা যায়। আগে এখানে হোটেল-টোটেল ছিল না, এখন অনেক হয়েছে। তবে এখনও ইচ্ছে করলে তাঁবু ভাড়া নিয়ে নদীর ধারে থাকা যায়। আমরা সেভাবেই থাকব বলে ঠিক করলাম।
চারটে ট্যাক্সি করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। চমৎকার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বারোটার মধ্যে আমরা পাহলগাম পৌঁছে গোলাম। শহরটা একপেশে; নদীর পশ্চিম দিকে শুধু পাহাড়, বাড়ি ঘরদের কিছুই নেই। আর পুব দিকে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে আছে হোটেল, রেস্টোর্যান্ট, দোকানপাট নিয়ে ছবির মতো শহর।
আমাদের তাঁবুর জন্য আগেই বলা ছিল, গিয়ে দেখি যে তাঁবু খাটাকার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। এ তাঁবু স্পেশাল ধরনের মজবুত তাঁবু, এতে ডাইনিং রুম, বেডরুম, অ্যািটচুড বাথরুম সবই আছে। আমাদের একটা তাঁবু আর মল্লিকদের দুটো। সামনে বিশ হাতের মধ্যে দিয়ে তোড়ে বয়ে চলেছে। লিন্দর নদী, তার একটানা শব্দ কখনও থামে না; লালমোহনবাবু হলিউডের ছবির কথায় চলে গেলেন; বললেন, মশাই, একমাত্র ওয়েস্টার্ন ছবিতেই এ রকম আউটডোর লাইফ দেখেছি; আমাদের আবার কোনও দিন এরকমভাবে থাকতে হবে, ভাবতে পারিনি।
দুপুরে তাঁবুতে লাঞ্চ খেয়ে (এখানেও সঙ্গে কিচেন রয়েছে) সবে বাইরে বেরিয়েছি। এমন সময় দেখি সুশান্ত সোম আমাদের তাঁবুর দিকে আসছেন।
লাঞ্চ শেষ? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
হ্যাঁ, বলল ফেলুদা।
এখান থেকে আট মাইল দূরে চন্দনওয়াড়ি বলে একটা জায়গা আছে জানেন তো?
যেখানে একটা বরফের ব্রিজ আছে-যেটা সারা বছর থাকে?
হ্যাঁ।
সেটা দেখতে যাবার মতলব করছেন নাকি?
গেলে সবাই একসঙ্গে গেলেই তো ভাল হয়?
তবে আজই সবে এলাম, আজ ভাবছিলাম পাহালগামটাই ঘুরে দেখব। চন্দনওয়াড়ি কাল গেলে হয় না?
আমাদেরও সেই আইডিয়া। আমি শুধু আপনাদের ইনভাইট করতে এলাম।
ফেলুদা বলল, অবশ্যই একসঙ্গে যাব। আমাকে ছাড়া বোধহয় আপনাদের আর চলবে না। এর মধ্যেই যা একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে গেল। এটাকে তো অ্যাটেমটেড় মার্ডার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বিজয়বাবুর খুব ভাগ্য ভাল যে, উনি বেঁচে গেলেন।
তা হলে কাল দুটো নাগাদ যাওয়া যাক। এখান থেকে আট মাইল ঘোড়া করে যেতে হয়। লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়া যাবে।
প্রয়াগ। প্রয়াগ? মিঃ মল্লিক ডাকতে ডাকতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর চোখে ভ্রূকুটি। এদিকে প্রয়াগ সামনেই নদীর ধারে হাত-মুখ ধুচ্ছে।
বোধহয় নদীর শব্দের জন্য শুনতে পাচ্ছে না, বলল ফেলুদা।
না, বললেন মিঃ মল্লিক, ও এমনিতেই কানো একটু খাটা, তিনবার না ডাকলে উত্তর দেয় না?
প্ৰয়াগ এবার ডাক শুনে মনিবের কাছে দৌড়ে গেল।
যাও, আমার, লাঠিটা নিয়ে এসো।
হুজুর, বলে প্রয়াগ তাঁবুর ভিতর চলে গেল।
কিছুক্ষণ থেকেই দেখছিলাম ফেলুদা প্রয়াগকে একদৃষ্টি লক্ষ করছে। কেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ইতিমধ্যে অন্য তাঁবুটা থেকে বিজয়বাবু আর মিঃ সরকারও বেরিয়ে এসেছেন। সরকার এঁদের সঙ্গ ছাড়েননি। মনে হয় পুরো টুরটাই এঁদের সঙ্গে ঘুরবেন।
আমরা কাল চন্দনওয়াড়ি যাচ্ছি, বললেন সুশান্তবাবু।
সকলে প্ৰস্তাবে সায় দিল।
ফেলুদা বলল, তোরা দুজনে ডেক-চেয়ার নিয়ে নদীর ধারে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ কর, আমি একটু পাহাড়ি পথে ঘুরে আসি। মাথাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার।
কতক্ষণের জন্য যাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এই ঘণ্টাখানেক, বলল ফেলুদা।
সঙ্গে আপনার বিশ্বস্ত অস্ত্রটি আছে তো?
তা আছে।
ফেলুদা চলে গেল।
লালমোহনবাবুর মাথায় একটা নতুন গল্পের প্লট এসেছে, সেটা আমাকে শুনিয়ে পরখ করে দেখে নিলেন। আমি আবার কিছু ইমপ্রুভমেন্ট সাজেস্ট করলাম। এই করতে করতে প্ৰায় ঘণ্টা দেড়েক বেরিয়ে গেল। নদীর ধারে বসে থাকলে বোরিং লাগে না, তাই সময়টা বেশ কেটে যাচ্ছিল, এমন সময় লালমোহনবাবু বললেন, দু ঘণ্টা হতে চলল, তবু তোমার দাদা এলেন না–
সত্যিই তো! এটা আমার খেয়ালই হয়নি।
কী করা যায়, বলো তো?
ফেলুদার সঙ্গে থেকে থেকে আমারও অভ্যোস হয়ে গেছে মুহূর্তে ডিসিশন নেবার।
আমি উঠে পড়লাম।
চলুন, ওকে খুঁজতে বেরোই।
চলো।
ফেলুদা কোন রাস্তা ধরেছে সেটা আমরা জানতাম। আমরা দুজনে সেই পাহাড়ি পথে চড়াই ধরে রওনা দিলাম। পাইন বনের মধ্যে দিয়ে পথ, পরিবেশ চমৎকার, কিন্তু আমাদের সে সব উপভোগ করবার মতো মনের অবস্থা নেই। ফেলুদা বলেছিল এক ঘণ্টায় ফিরবে; এ বিষয়ে ওর কথার নড়াচড় হয় না। কিছু একটা গণ্ডগোল নিশ্চয়ই হয়েছে।
আধা ঘণ্টা হাঁটার পরেই যা খুঁজছিলাম, তা পেয়ে গেলাম। একটা ঝোপের ধারে মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ফেলুদা। আমার গলা মুহূর্তে শুকিয়ে গেল।