একশোবার।..এবার আরও দু-এক জন সম্বন্ধে আপনাকে আরও দু-একটা প্রশ্ন করে নিই। ডাঃ মজুমদারকে আপনি ক’দিন থেকে চেনেন?
উনি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আজ প্রায় পনেরো বছর হল।
বেশ। এবার সুশান্তবাবুকে একটা প্রশ্ন।
সুশান্তবাবু বললেন, বলুন।
আপনি কতদিন হল মিঃ মল্লিকের সেক্রেটারির কাজ করছেন?
ওঁর রিটায়ার করার সময় থেকেই। তার মানে পাঁচ বছর।
বেয়ারা প্ৰয়াগ কত দিন আছে?
ও-ও আন্দাজ পাঁচ বছর। মিঃ মল্লিকের পুরনো বেয়ারা মকবুল হঠাৎ মারা যায়। তারপর উনি প্ৰয়াগকে রাখেন।
বেশ, আজ এই পর্যন্তই থাক। তবে পরে দরকার হলে আবার প্রশ্ন করতে পারি তো?
নিশ্চয়ই, বললেন বিজয়বাবু।
০৬. আবার যেই কে সেই
কী মশাই, আবার যেই কে সেই?
শ্ৰীনগর ফিরে এসে আমরা সকালে বোটের উপরের ডেকে বসে চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় লালমোহনবাবু মন্তব্যটা করলেন।
যেই কে সেই, বলল ফেলুদা।যা বুঝছি, ছুটি-ভোগ মানেই দুভোগ। ক্রাইম যেন আমাদের পিছনে ওত পেতে থাকে, একটু আরাম করলেই ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে এবার যে রকম হতভম্ব হয়েছি, সে রকম কখনও হয়েছি বলে মনে পড়ে না। কোনও খুঁটিই যেন খুঁজে পাচ্ছি না, যেটা ধরে একটু এগোব! সব অন্ধকার।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে চা-টা শেষ করে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, সুশান্তবাবুকে বলতে হবে একবার যদি মিঃ মল্লিকের ডায়েরিগুলো দেন।
ও ডায়েরি দিয়ে আপনার কী লাভ? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
কীসে কী কাজ দেয় তা আগে থেকে কেউ বলতে পারে? অবশ্য মিঃ মল্লিকের রাজি হওয়া চাই। সেটা সুশান্তবাবুকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে।
তা, সে তো এখনই পারেন-ওই তো সুশান্তবাবু।
সত্যিই দেখি, ভদ্রলোক শিকার করে বুলেভার্ডের দিক থেকে ফিরছেন, সঙ্গে কিছু খরিদ করা জিনিসপত্র।
ফেলুদা ডেকের রেলিং-এর পাশে ঝুঁকে পড়ে ডাক দিল।
ও মশাই, এক মিনিট এদিকে আসতে পারেন?
শিকারাটা আমাদের বোটের কাছে চলে এল। ফেলুদা বলল, মিঃ মল্লিকের ডায়েরিগুলো কি আপনি সঙ্গে এনেছেন?
সবগুলো, বললেন সুশান্তবাবু, চব্বিশটা আছে।
ওগুলো দু-তিনটে করে ধার নিতে পারি? মল্লিক ফ্যামিলি সম্বন্ধে আরেকটু জানতে না পারলে আমি এই নতুন পরিস্থিতির ঠিক কিনারা করতে পারছি না। আমার মনে হয় ডায়েরিগুলো পড়লে কিছুটা সুবিধা হতে পারে।
সুশান্তবাবু বললেন, আমি একবার সাহেবকে জিজ্ঞেস করি।
নিশ্চয়ই।
আমার মনে হয় না। উনি কোনও আপত্তি করবেন, কারণ আপনারা তো সবই শুনেছেন ওঁর মুখ থেকে।
আধা ঘণ্টার মধ্যে সুশান্তবাবু চারটে পুরনো ডায়েরি সঙ্গে নিয়ে আমাদের হাউসবোটে এসে হাজির; বললেন, এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, জীবনী যখন বেরোবে, তখন তো সবই জনাজানি হয়ে যাবে কাজেই এখন পড়তে দিতে আর কী আপত্তি থাকতে পারে? আর ক্রাইমের কথাই যদি হয়, তা হলে সবই তো খবরের কাগজের রিপোর্টে বেরিয়েছে।
ফেলুদা বলল, এগুলো দেখা হয়ে গেলে আর এক সেট আমি আপনার কাছ থেকে চেয়ে আনব!..তোপ্সে-তুই আর লালমোহনবাবু বরং যা, মানসবল লেকটা দেখে আয়। আমি এখন একটু ঘরে বসে কাজ করব।
ভাল কথা, বললেন সুশান্তবাবু, আপনারা পাহালগাম যাবেন না?
ইচ্ছে তো আছে।
কবে যাবেন? আমার মনে হয় আমাদের সঙ্গে গেলেই ভাল। আমরা পরশু যাচ্ছি।
ভেরি গুড।
মানসবল লেকের মতো স্বচ্ছ জল আমি আর কোনও লেকে দেখিনি; জলের একেবারে তল অবধি উদ্ভিদ দেখা যায়। ভারী অদ্ভুত লাগে দেখতে।
লালমোহনবাবু দৃশ্য উপভোগ করলেন ঠিকই, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, মাঝে মাঝে ওঁর ফেলুদার তদন্তের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একবার বললেন, তোমার দাদা ওই ডায়েরিগুলো পড়ছেন কেন জানি না। যাদের একবার ফাঁসি হয়ে গেছে তারা তো আর খুনখারাপি করতে পারবে না।
আমি বললাম, সেটা ফেলুদাকেই বুঝতে দিন না।
মানসবল শ্ৰীনগর থেকে আঠারো মাইল দূরে; আমাদের ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। ফেলুদা দেখলাম বৈঠকখানার সোফায় বসে তখনও ডায়েরি নিয়ে পড়ছে। বলল, সারা দিনে বারোটা ডায়েরি পড়ে শেষ করেছে এবং সব কটাই নাকি ইন্টারেস্টিং।
কোনও কাজ হল কি? জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
ফেলুদা বলল, কাজ কীসে হয়, সেটা অনেক সময় আগে থেকে বোঝা যায় না। আপাতত আমার কাজ হচ্ছে তথ্য সংগ্ৰহ করা। নতুন তথ্য কিছু বেরিয়েছে—শুধু ডায়েরি থেকে নয়। যেমন বিজয়বাবু বলেছেন যে সেদিন যে উনি ঘাড়ে ধাক্কা খেয়েছিলেন তখন একটা ঠাণ্ডা, ধাতব স্পর্শ অনুভব করেছিলেন। আমার মতে সেটা আংটি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। তবে তাতেও যে খুব সুবিধে হচ্ছে তা নয়, কারণ আংটি এখানে তিনজন পারেন-সুশান্তবাবু, মিঃ সরকার আর প্রয়াগ। আর যদি এ দলের বাইরে কেউ থাকে তা হলে তো চমৎকার। তা হলে আমাদের কোনও তদন্তই কাজ দেবে না।
কিন্তু সে রকম দল কি বেশি ছিল? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু!
তা ছিল না ঠিকই।
আমার তো একটিও মনে পড়ছে না।
একটি ছিল-পাঞ্জাবি দল–তবে তাদের পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই ছিল ঘোড়ার পিঠে।
আশা করি আর কোনও গোলমাল হবে না।
আপনার মুখে ফুল-চন্দন পডুক। ভূস্বর্গে এসে এ সব ঝামেলা ভাল লাগে না-বিশেষ করে যখন বুদ্ধি খাটাবার কোনও স্কোপ পাওয়া যাচ্ছে না।
*
পাহালগাম যাবার আগে আমরা শ্ৰীনগরে আর এক’দিন ছিলাম, তার মধ্যে ফেলুদা মিঃ মল্লিকের বাকি ডায়েরিগুলো পড়া শেষ করে ফেলল।