বিজয়বাবু বেশ জোরের সঙ্গে মাথা নেড়ে না বললেন।
বাবার ভীমরতি ধরেছে, বললেন বিজয়বাবু। একজন খুনি মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাবে এর চেয়ে অন্যায়। আর কিছু হতে পারে না।
আপনি সে কথা বাবাকে বলেননি?
বাবার সঙ্গে আমার সে রকম সম্পর্ক নয়। উনি আমার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেন না, আমিও ওঁর ব্যাপারে কিছু বলি না।
আই সি।
তবে বাবা যা করছেন তা করে যদি শান্তি পান, তা হলে আমার বলবার কিছু নেই।
আপনার মা নেই?
না। মা বছর চারেক হল মারা গেছেন।
এক দাদা ছিল, আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং করত, সে গত বছর মারা যায়। তার মেমসাহেব বউ আর এদেশে আসেনি। এক বোন আছে, তার স্বামী ভূপালে কাজ করে।
আমার বিশ্বাস আপনার কাশ্মীরের দৃশ্য সম্পর্কে খুব একটা কৌতূহল নেই।
কী করে বুঝলেন?
কারণ যে পরিমাণ সময় ঘরে বসে তাস খেলে কাটান।
আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার মনে কাব্য নেই। আমি কাঠখোট্টা মানুষ। আমার দু-একজন বন্ধু আর দু প্যাকেট তাস হলেই হল।
সরকার একটু হেসে বলল, আমি কিন্তু তাসও খেলি, আবার দৃশ্যও দেখি! সেটা বোধহয় ছেলেবেলায় কাশ্মীরে থাকার জন্য হয়েছে।
যাই হাক-বিজয়বাবু উঠে পড়লেন—আমাদের কিন্তু তাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আজ সুশান্তকে দলে টেনেছি। আপনারা কেউ—?
আমরা ভাবছিলাম একটু ঘুরতে বেরোব। আপনারা এখন কিছুক্ষণ খেলবেন তো?
এগারোটা পর্যন্ত তো বটেই।
তা হলে ফিরে এসে একবার ঢুঁ মারব।
বেশ। কাল আবার দেখা হবে।
তিন ভদ্রলোক গুডবাই করে চলে গেলেন। লালমোহনবাবু বললেন, এখন না বেরিয়ে আফটার ডিনার ওয়াকে বেরোলে ভাল হত না?
তথাস্তু, বলল ফেলুদা।
এখানে ক্যাবিনের সঙ্গে বাবুর্চি রয়েছে, তাকে বলে দিয়েছিলাম রাত্তিরে ভাত আর মুরগির কারি খাব। দেখলাম দিব্যি রান্না করে। সাড়ে আটটার মধ্যে খাওয়া হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না, তাই তিনজনেই বেশ উৎসাহের সঙ্গে রাতের গুলমার্গ শহর দেখতে বেরেলাম।
নিরিবিলি শহর, তার মধ্যে দিয়ে তিনজন হেঁটে চলেছি। পথে যে লোক একেবারে নেই, তা নয়। ভারতীয়দের মধ্যে বিদেশি টুরিস্টও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। সত্যি বলতে কী, হিসেব নিলে বোধহয় বিদেশি টুরিস্টই সংখ্যায় বেশি হবে। লালমোহনবাবু এখনও গুনগুন করে গজল গাইছেন, খালি শীতের জন্য গল্যা মাঝে মাঝে অযথা গিটকিরি এসে যাচ্ছে।
শীত লাগছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তা লাগছে, তবে মনে হয় খুব স্বাস্থ্যকর ঠাণ্ডা।
তা হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় এ সব জায়গায় বেশি রাত না করাই ভাল। চ তোপ্সে, ফেরা যাক।
আমরা উলটামুখে ঘুরলাম। শহর আর আমাদের ক্যাবিনের মধ্যে একটা ব্যবধান আছে। সেখানটা বসতি নেই বললেই চলে। আমরা সেই জায়গাটা দিয়ে হাটছি। এমন সময় হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটল। একটা কী জানি জিনিস শনশন শব্দে আমাদের মাথার পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারের একটা গাছের গায়ে লেগে মাটিতে পড়ে গেল। আমাদের মাথা বলছি, কিন্তু আসলে সেটা ঠিক ফেলুদার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ফেলুদার কাছে টর্চ ছিল, সেটা জ্বলিয়ে গাছের তলায় ফেলতেই দেখা গেল বেশ বড় একটা পাথর। সেটা ফেলুদার মাথায় লাগলো নির্ঘাত একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড হত।
প্রশ্ন হচ্ছে -কে এই লোকটা, যে এভাবে আক্রমণটা করল? আর এর কারণই বা কী? আমরা তো সবে এখানে এসেছি। এখনও গোলমেলে ব্যাপার কিছু ঘটেনি, তদন্তের কোনও প্রশ্নই উঠছে না, তা হলে এই হুমকির মানে কী?
ক্যাবিনে ফিরে এসে ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগছে না। আমাকে পছন্দ করছে না কেউ; এবং গোয়েন্দাকে হটানোর চেষ্টার একটাই কারণ হতে পারে—কোনও কুকীর্তি হতে চলেছে। অথচ সেটা যে কী, সেটা আন্দাজ করার কোনও উপায় নেই।
লালমোহনবাবু বললেন, আপনার সেই -৩২ কোল্ট রিভলভারটা আশা করি এনেছেন। ফেলুদা বলল, ওটা বাক্সেই রাখা থাকে। কিন্তু রিভলভার ব্যবহার করার সময় এখন এল কই? কোনও ক্রাইম তো ঘটেনি এখনও।
যাই হাক, রাত্তিরে দরজা-জানালা সব ভাল করে বন্ধ করে শুতে হবে। এখানে রিস্ক নেওয়া চলবে না। আশ্চর্য ব্যাপার মশাই!—আপনার সঙ্গে ছুটিতে কোথাও বেরোলেই কি গণ্ডগোল শুরু হবে?
ফেলুদা একটু ভেবে বলল, যাই, ওদের সঙ্গে একটু তাস পিটিয়ে আসি। আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরব। আপনারা শুয়ে পড়ুন।
০৫. খিলেনমার্গ যেতে হলে
আগেই বলেছি যে খিলেনমার্গ যেতে হলে তিন মাইল পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে দু হাজার ফুট উপরে উঠতে হয়। আমরা দুই ক্যাবিনে বাসিন্দারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে, তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। সেটাই করা হল।
আমাদের মধ্যে এক মিঃ মল্লিকই ঘোড়া নিলেন, আর সকলে হেঁটে যাওয়া স্থির করলাম। শুনেছি, পথের দৃশ্য অতি চমৎকার, আর দুপাশে অনেক ফুল গাছ।
লালমোহনবাবু বললেন, এই সাত দিনেই এনার্জি বেড়ে গেছে মশাই।হেঁটে দু হাজার ফুট পাহাড়ে ওঠাটা কোনও ব্যাপারই বলে মনে হচ্ছে না।
সত্যিই পথের দৃশ্য অপূর্ব। আমরা তিনজনে মোটামুটি একসঙ্গে হাঁটছি, বাকি ওদের দল ভাগ ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দলে আছি সবসুদ্ধ ন জন—আমরা তিনজন, মিঃ মল্লিক, বিজয় মল্লিক, ডাঃ মজুমদার, সুশান্তবাবু, মিস্টার সরকার আর বেয়ারা প্রয়াগ।
প্রায় দু ঘণ্টা লাগল দু হাজার ফুট উঠতে; আর উঠেই এক আশ্চর্য দৃশ্য আমাদের হকচাকিয়ে দিল। আমরা একটা পাহাড়ের পিঠে এসে উপস্থিত হয়েছি, মাটিতে বরফ, সামনে বরফের পাহাড় আর উলটা দিকে ছড়িয়ে আছে গাছপালা নদী হ্রদ-সমেত দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যক, আর তারও পিছনে আকাশের গায়ে যেন খোদাই করা রয়েছে নাঙ্গা পৰ্ব্বত।