আমি চাই তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
সেটা আমি খুব সহজেই করতে পারি। তবে আমার আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা ক্ষমা করবেন কি না জানি না।
তাদের কথা আমি ভাবছি না। তোমার ক্ষমাটাই আমার প্রয়োজন।
মৃত্যুর পর আর কারুর ওপর কোনও আক্রোশ থাকে না।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
মিঃ মল্লিক উঠে গিয়ে ঘরের বাতিটা জ্বলিয়ে দিলেন। ডাঃ মজুমদারের জ্ঞান আসতে আরও মিনিট দু-এক লাগল।
এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল বটে।
মনটা অনেকটা হালকা লাগছে, বললেন মিঃ মল্লিক, এই একটি মৃত্যুদণ্ডে যে আমি ভুল করেছিলাম, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এবং এখন তো বুঝতেই পারছি যে আমার ধারণাই ঠিক।
ফেলুদা বলল, এই প্ল্যানচেট করে কি আপনি নিজের মনটাকে হালকা করতে চান?
শুধু তাই নয়, বললেন মিঃ মল্লিক, আমার মনে মাঝে মাঝে একটা সন্দেহ জাগে যে, আদৌ একজন মানুষ আরেকজনের প্রাণদণ্ড দিতে পারে কি না।
কিন্তু তা হলে খুনির শাস্তি হবে না?
হবে—কিন্তু প্রাণদণ্ডের দ্বারা নয়। কারাদণ্ড নিশ্চয়ই চলতে পারে। তা ছাড়া অপরাধীর সংস্কারের জন্য রাস্তা বার করতে হবে।
ঘড়িতে প্ৰায় এগারোটা বাজে, তাই আমরা উঠে পড়লাম। মল্লিক বলেন, আমরা গুলমাৰ্গ যাচ্ছি। পরশু। আপনারা আসুন না। আমাদের সঙ্গে।
ফেলুদা বলল, সে তো খুব ভালই হয়। ওখানে কি থাকবেন?
এক রাত, বললেন ভদ্রলোক।গুলমাৰ্গ থেকে খিলেন।মার্গ যাব।— তিন মাইল পথা— হেঁটেও যাওয়া যায়, ঘোড়াতেও যাওয়া যায়। তারপর ফিরে এসে এক রাত থাকা। এখান থেকেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে; আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্সিই আপনাদেরটাও করে দেবে।
সেই কথা রইল। আমরা তিনজনে আমাদের হাউসবোটে ফিরে এলাম।
ফেলুদা শুতে যাবার আগে বলল, মল্লিকমশাইয়ের ধারণাটাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করা চলে না। একজন খুনির প্রাণদণ্ড হবে না সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। ভদ্রলোকের আসলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশক্তির খানিকটা গোলমাল হয়ে গেছে। অবিশ্যি একজন জজের এটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
তবে ভেবে দেখুন, বললেন লালমোহনবাবু, এক কথায় একটা লোকের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। কতখানি ক্ষমতা দেওয়া থাকে। একজন জজের হাতে। এই ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়লে একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষের মনে সংশয় আসতে পারে বইকী!
সেটা অবশ্য ঠিক, বলল ফেলুদা।
০৪. হ্রদ, নদী, বাগ-বাগিচা
শ্ৰীনগরের সঙ্গে গুলমার্গের কোনও মিলই নেই। এখানে হ্রদ, নদী, বাগ-বাগিচা ইত্যাদি কিছুই নেই; যা আছে, তা হল ঢেউ খেলানো পাহাড়ের গায়ে মসৃণ ঘন সবুজ ঘাস—যা দেখতে একেবারে মখমলের মতো; আর আছে ঝাউ বন আর পাইন বন আর ইতস্তত ছড়ানো কিছু কাঠের ঘর বাড়ি। সব মিলিয়ে ছবির মতো সুন্দর। এই পাহাড়ের গায়েই গলফ খেলা হয়। আর শীতকালে যখন ঘাস বরফে ঢেকে যায়। তখন স্কিইং হয়।
শ্ৰীনগর থেকে টাংমার্গ পর্যন্ত আঠাশ মাইল ট্যাক্সি করেই আসতে হয়, তারপর শেষের চড়াই চার মাইল যেতে হয় ঘোড়াতে। কলকাতায় থাকতেই ফেলুদা লালমোহনবাবুকে বলে দিয়েছিল যে কাশ্মীরে ঘোড়ায় চড়তে হবে। -ভয় নেই, উটের চেয়ে অনেক সহজ। লালমোহনবাবু একেবারে পাকাপোক্ত রাইডিং ব্রিচেস করিয়ে এনেছিলেন। গুলমার্গে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বললেন ঘোড়া চড়ার মতো সহজ ব্যাপার আর নেই।
আমাদের সঙ্গে মল্লিক। মশাইরাও এসেছেন। আমরা আজকের রাতটা গুলমার্গে থেকে কাল এখান থেকে তিন মাইল দূরে আর দু হাজার ফুট ওপরে খিলেন।মার্গ দেখে বিকেলেই শ্ৰীনগর ফিরে যাব।
থাকার জন্য আমরা পাশাপাশি দুটো ক্যাবিন নিয়েছি। আমাদেরটা ছাট, ওদেরটা বড়। বিকেলে ক্যাবিনের বরাদ্দায় বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় তিনজন ভদ্রলোক এসে হাজির-সুশান্তবাবু, সিদ্ধেশ্বর মল্লিকের ছেলে বিজয়বাবু আর আরেকজন—ষাকে আমরা চিনি না, সুপুরুষ চেহারা, টকটকে রং, বয়স ত্রিশ-বেত্ৰিশ। সত্যি বলতে কী, তিনজনেই মোটামুটি এক বয়সী।
সুশান্তবাবু নতুন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, এঁর নাম অরুণ সরকারী! ইনি কলকাতায় ব্যবসা করেন। আমাদের সঙ্গে এখানে এসে আলাপ। জুয়াড়িদের একজন বললে বোধহয় আপনার চিনতে আরও সুবিধে হবে।
সকলেই হেসে উঠল। সুশান্তবাবু বললেন, আমরা এসেছি কেন বোধহয় বুঝতেই পারছেন। প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরের সঙ্গে আলাপ করতে এঁরা দুজনেই খুব ব্যগ্ৰ। তা ছাড়া শুনছিলাম আপনার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীও তো একজন নামী লেখক-ওঁর সর্ব বই-ই নাকি বেস্ট-সেলার।
লালমোহনবাবু মাথা হেঁট করে হেঁ হেঁ করে একটু বিনয়ের ভাব দেখালেন।
বিজয় মল্লিক আর অরুণ সরকারের খাতিরে ফেলুদাকে তার গোটা দু-তিন বিখ্যাত কেসের বর্ণনা দিতে হল। শেষ হয়ে যাবার পর সরকার ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি কাশ্মীরে এই প্রথম?
ফেলুদা বলল, হ্যাঁ, এই প্রথম। আমি কিন্তু আপনাকে প্রথমে দেখে কাশ্মীরি ভেবেছিলাম। আপনি বোধহয় এখানে আর একবার এসেছেন?
তা এসেছি, বললেন সরকার। ইন ফ্যাক্ট, আমার ছেলেবেলার কয়েকটা বছর শ্ৰীনগরেই কেটেছে। বাবা এখানে একটা হোটেলে ম্যানেজারি করতেন। তারপর বছর কুড়ি আগে আমরা কলকাতা চলে যাই।
এখানকার ভাষা আপনার জানা নেই?
তা অল্পবিস্তর আছে বইকী।
এবার ফেলুদা বিজয় মল্লিকের দিকে ফিরল!
আপনার বাবার প্ল্যানচেট সম্বন্ধে আপনার কোনও কৌতূহল নেই?