তা হলে আপনি একটু জিজ্ঞেস করে জানাবেন।
নিশ্চয়ই।
আমরা চা খাওয়া শেষ করে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে নিজেদের বোটে চলে এলাম। বৈঠকখানায় ঢুকে সোফায় ধাপ করে বসে পড়ে লালমোহনবাবু বললেন, হাইলি ইন্টারেস্টিং ম্যান—দিস জজ সাহেব।
ইন্টারেস্টিং তো বটেই, বলল ফেলুদা, তবে উনিই একমাত্র জজ নন, যাঁর এইরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ রকম ঘটনা দেশে-বিদেশে আগেও শোনা গেছে।
ভাল কথা-আপনার সঙ্গে আমার পারমিশনটাও চেয়ে রাখবেন। প্ল্যানচেট দেখার সুযোগ ছাড়া যায় না।
০৩. চার দিন কেটে গেল
দেখতে দেখতে চার দিন কেটে গেল। এর মধ্যে এক’দিন শহরটা ঘুরে দেখলাম। লালমোহনবাবু একটা হটশট ক্যামেরা কিনেছেন, তাই দিয়ে পটাপট ছবি তুলছেন। সেগুলো শহরের মাহাত্তা অ্যান্ড কোম্পানিতে ডেভেলপ আর প্রিন্ট করে দেখা গেল মন্দ ওঠেনি। যদিও লালমোহনবাবুর নিজের মন্তব্য হাইলি প্রেফেশনাল মোটেই মানা যায় না।
নিশাদবাগ, শালিমার আর চশমা শাহিও এক সকলে বেরিয়ে দেখে এলাম। মনটা চলে গেল। সেই জাহাঙ্গির শাজাহানের আমলে। এই ট্রিপটা আমরা করেছিলাম মল্লিক ফ্যামিলির সঙ্গে, ফলে তাদের সঙ্গে আলাপটাও আরও জমে উঠল। সিদ্ধেশ্বরবাবু ফেলুদাকে বললেন, আপনি শুনছি। আমার প্ল্যানচেট সম্বন্ধে কৌতুহল প্রকাশ করেছেন। আপনি প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করেন?
আমার মনটা খুব খোলা, জানেন, বলল ফেলুদা।প্ল্যানচেট, স্পিরিচুয়ালিজম ইত্যাদি। সম্বন্ধে আমি অনেক পড়েছি; পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যে সম্ভব সেটা বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি বলে গেছেন; সেক্ষেত্রে প্ল্যানচেট সম্বন্ধে অবজ্ঞা প্রকাশ করার কোনও মানে হয় না। তবে যেমন সব কিছুর মধ্যেও থাকে তেমনই এর মধ্যেও ধাপ্পাবাজি চলে। আসলে মিডিয়ম যদি খাঁটি হয় তা হলেই ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
ডাঃ মজুমদার ইজ এ ফাস্ট রেট মিডিয়াম। আপনি এক’দিন বসে দেখুন না।
হ্যাঁ, কিন্তু আমার বন্ধু আর আমার ভাইও আসতে চায়।
মনে বিশ্বাস থাকলে কোনও লোকের আসাতেই আমার আপত্তি নেই। আজই আসুন। ভাল কথা, আমি কাদের আত্মা নামাচ্ছি জানেন তো?
যে সব লোককে আপনি প্ৰাণদণ্ড দিয়েছেন তাদের তো?
হ্যাঁ! আমি জানতে চাইছি। আমার জাজমেন্টে কোনও ভুলে হয়েছে কি না। এখন পর্যন্ত সে রকম ভুল পাইনি।
আপনারা রোজ একটি করে আত্মা নামান?
হ্যাঁ। একটার বেশিতেডাক্তারের ষ্ট্রেন হয়।
তা হলে কটায় আসব?
আসুন রাত দশটায়! ডিনারের পর বসা যাবে। তখন চারিদিকটা বেশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
ডিনারের পর আমরা মিঃ মল্লিকের হাউসবোটে গিয়ে হাজির হলাম। বসবার ঘরে প্ল্যানচেটের ব্যবস্থা হয়েছে। একটা টেবিলকে ঘিরে পাঁচটা চেয়ার রাখা হয়েছে; বুঝলাম চেয়ারগুলো খাবার ঘর থেকে আনা হয়েছে। আমরা আর সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে গেলাম। মিঃ মল্লিক বললেন, আজ আমরা রামস্বরূপ রাউত বলে একটি বিহারি ছেলের আত্মাকে নামাব। এই ছেলেটির আজ থেকে দশ বছর আগে ফাঁসি হয়, এবং আমিই সে ফাঁসির জন্য দায়ী ছিলাম। আমার বিশ্বাস এর ফাঁসির দণ্ড হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু জুরির ভার্ভিক্ট ছিল গিল্টি, আর খুনটাও ছিল একটু নৃশংস ধরনের। তাই আমি সাময়িক ভ্ৰান্তিবশত জেনেশুনেও প্রাণদণ্ডের আদেশ দিই। যদিও আমার মনে এই আদেশের যথার্থতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কেসটা এমন চতুরভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে ছেলেটিকে অপরাধী বলেই মনে হয়।…মজুমদার তুমি তৈরি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
জানালার সব পর্যাদা টেনে দিয়ে ঘরটাকে একেবারে অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সকলে যে যার জায়গায় বসেছি। আমার ডান দিকে ফেলুদা, বাঁ দিকে লালমোহনবাবু, ফেলুদার ডান পাশে মিঃ মল্লিক। আর তাঁর পাশে–লালমোহনবাবুর বাঁ দিকে–ডাঃ মজুমদার।
মিঃ মল্লিক গম্ভীরভাবে বললেন, ছেলেটির বয়স ছিল। উনিশ। শার্প চেহারা, ন্যাকের নীচে সরু গোঁফ, গায়ের রং পরিষ্কার। বিহারের ছেলে-নাম রামস্বরূপ রাউত। ছুরি দিয়ে খুনের মামলা, ঘটনাস্থল কলকাতার বাগবাজারের একটা গলি। ছেলেটিকে দেখে কিন্তু খুনি বলে মনে হয়নি। আপনারা নিজেদের কল্পনা অনুযায়ী একটা চেহারা স্থির করে নিয়ে তাতে মনঃসংযোগ করতে চেষ্টা করুন। প্রশ্ন আমিই করব, উত্তর মজুমদারের মুখ দিয়ে আসামির কণ্ঠস্বরে বেরোবে।
পনেরো মিনিট এইভাবে অন্ধকারে বসে থাকার পরই বুঝলাম টেবিলটা আস্তে আস্তে নড়তে আরম্ভ করেছে। তার পর আরও জোরে দোলানি শুরু হল। আমি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মিনিট খানেক পরে, মল্লিকমশাই প্রশ্ন করলেন–হিন্দিতে।
তুমি কে?
আমার নাম রামস্বরূপ রাউত।
ডাক্তারের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল, কিন্তু কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ আলাদা। শুনে বেশ গ শিউরে ওঠে।
মিঃ মল্পিক আবার প্রশ্ন করলেন–
তোমার ফাঁসি হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে?
হ্যাঁ।
আমি তোমার মৃত্যুদণ্ডের জন্য দায়ী, তা তুমি জানো?
জানি।
খুনটা কি তুমিই করেছিলে?
না।
তবে কে করেছিল?
ছেদিলাল। সে ভয়ানক ধূর্ত ছিল। তার অপরাধ সে অত্যন্ত চতুরভাবে আমার ঘাড়ে ফেলে। পুলিশ আমাকেই দাষী সাব্যস্ত করে।
আমি সেটা জানি। আমি তোমায় দেখেই বুঝেছিলাম যে তোমার দ্বারা এ খুন করা সম্ভব নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করি।
সে নিয়ে এখন আর ভেবে কী হবে?