ফেলুদা বলল, ওটাকে বলে চার মিনার। দ্বীপটার চার কোণে চারটি চিনার গাছ রয়েছে।
মাহমুদিয়া আর আবদুল্লা শিকারা চালাতে আরম্ভ করল, আমরা বাঁয়ে গোটা দশেক হাউসবোট পেরিয়ে আসল লেকে গিয়ে পড়লাম! দুটো পাশাপাশি হাউসবোট নিয়ে রয়েছেন রিটায়ার্ড জজ সিদ্ধেশ্বর মল্লিক। আর তাঁর সঙ্গোপাঙ্গ; আমরা খোলা লেকে পড়বার আগে একটা বোট থেকে সুশান্ত সোম আমাদের দিকে হাত নেড়ে বললেন, ফেরার পথে একবার ঢুঁ মেরে যাবেন। চায়ের নেমন্তন্ন রইল।
ডাল লেকের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। স্বচ্ছ কাচের মতো জল, হাওয়া নেই বলে ঢেউ নেই, তাই আয়নার মতো চারিদিকের পাহাড়গুলো প্ৰতিফলিত হচ্ছে। এখানে-ওখানে পদ্ম শালুক শাপলা ফুটে আছে, শিকার সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। লালমোহনবাবুকে কবিতায় পেয়েছে, বললেন, কাশ্মীর সম্পর্কে আমাদের এথিনিয়াম ইস্কুকের মাস্টার বৈকুণ্ঠ মল্লিকের একটা আট লাইনের কবিতা আছে। ভদ্রলোক বহু জায়গায় ঘুরেছিলেন, আর সেই সব জায়গা নিয়ে পদ্য লিখে গেছেন। কাশ্মীরেরটা শুনুন ফেলুবাবু, কী রকম ডিসেন্ট–
করি নত শির
তোমারে প্রণমি কাশ্মীর
কুমারীকার অপর প্রান্তে
অবস্থান তব ভারতের উত্তর সীমান্তে
রাজধানী শ্ৰীনগর
ঝিলামের জলে ধায় অপূর্ব শহর
কত হ্রদ, কত বাগ, কত বাগিচা
অন্য নগরের সাথে তুলনা করিতে যাওয়া মিছা।…
বাঃ, দিব্যি, বলল ফেলুদা—যদিও বুঝলাম সেটা জটায়ুর মনে কষ্ট না দেবার জন্য। কবিতায় লালমোহনবাবুর রুচিটা যে একটু গোলমেলে তার পরিচয় এর আগেও অনেকবার পেয়েছি।
শুধু কবিতা নয়, ডাল লেকের দৃশ্যে ভদ্রলোককে গানেও পেয়েছে। গুনগুন করে কী গাইছেন জিজ্ঞেস করাতে বললেন উর্দু গজল।
এদিকে সন্ধ্যার আলো অনেক বেশিক্ষণ থাকে-অন্তত বছরের এই সময়টায়। আমরা সাড়ে সাতটায় যখন ফিরছি তখনও পুরো অন্ধকার হয়নি।
সুশান্ত সোম তাঁদের হাউসবাটের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।
আসুন, একটু আড্ডা মারা যাক।
আমরা এদের বোটের সামনে শিকারা দাঁড় করিয়ে ওপরে উঠলাম। এঁদের বোটের নাম রোজমেরি। এঁদের পাশেই রয়েছে। এদের অন্য বোট, সেটার নাম মিরান্ডা।রোজমেরি-তে থাকেন সুশান্ত সোম আর জজ সাহেবের ছেলে, নাম বিজয় মল্লিক। মিরাল্ড-তে আছেন মিঃ মল্লিক, তার ডাক্তার হরিনাথ মজুমদার আর বেয়ারা প্রয়াগ।
চায়ের অর্ডার দিয়ে উপরের ডেকে উঠে সুশান্ত ফেলুদাকে বললেন, আপনার তাস চলে? তিন-তাস?
অভ্যোস নেই, বলল ফেলুদা, তবে তাসের প্রায় সব খেলাই মোটামুটি জানা আছে। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
নীচের বৈঠকখানায় তাসের আড্ডা জমেছে।
এত লোক পেলেন কোথায়?
প্লেনে দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বিজয়ের। একজন বাঙালি, নাম সরকার; আর একজন পাঞ্জাবি। তিন জনেই জুয়াড়ি।
আমরা চারজনে বসলাম! সত্যি, কলকাতা যে কোন সুদূরে চলে গেছে তার কোনও হিসাবই নেই। হাউসবোটের টপ ডেকে বসে চা খাওয়ার আয়োজন-এ এক অভাবনীয় ব্যাপার। আমাদের ডান দিকের হাউসবোটে সাহেবরা এসে উঠেছে–সেখান থেকে বিলিতি বাজনার শব্দ আসছে। জানাল দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাহেব-মোম সেই বাজনার সঙ্গে নাচছে সামনের বৈঠকখানায়।
ফেলুদা সুশান্তবাবুকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল, সিদ্ধেশ্বরবাবু কদিন হল রিটায়ার করেছেন?
পাঁচ বছর, বললেন সুশান্তবাবু। ওঁর তখন ষাট বছর বয়স।
কিন্তু জজের তো রিটায়ার করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
ওর শরীরটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অ্যানজাইনা। ভদ্রলোকের রিটায়ার করার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ডাক্তারের কথায় বাধ্য হয়ে করতে হয়। উনি বহু অপরাধীর প্রাণদণ্ড দিয়েছেন। এক-এক সময় বলেন, আমার শেষ জীবনে দুঃখ আছে। এত লোককে ফাঁসিতে পাঠালে তার একটা প্রতিক্রিয়া হবেই। উনি ডায়েরি লিখতেন; সে ডায়েরি সব এখন আমার হাতে কারণ আমি ওঁর একটা জীবনী লিখছি।–যদিও সেটা আত্মজীবনী হিসেবেই বেরোবে। সেই ড্রায়েরিতে উনি যেদিনই কারুর প্রাণদণ্ড দিয়েছেন সেদিনই লাল কালিতে একটা ক্রস দিয়ে রেখেছেন। মাঝে মাঝে ক্রসের সঙ্গে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। সেটাতে বুঝতে হবে প্ৰাণদণ্ড দিয়ে নিজেরই মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে এটা ঠিক হল কি না। এখন কী করছেন জানেন? ওঁর যে ডাক্তার–মজুমদার-তিনি ভাল মিডিয়ম—তাঁর সাহায্যে প্লানচেট করছেন, আর ফাঁসির আসামিদের আত্মাদের ডেকে এনে তাদের জিজ্ঞেস করছেন, তারা সত্যিই খুন করেছিল। কিনা। আত্মা যদি বলে যে হ্যাঁ, সে সত্যিই খুন করেছিল, তা হলে উনি খানিকটা নিশ্চিন্তবোধ করেন; এখন পর্যন্ত ওর জাজমেন্টে কোনও ভুল বেরোয়নি।
আপনারা কি এখানে এসেও প্ল্যানচেট করবেন নাকি?
সেই জন্যেই তো ডাক্তারকে একই হাউসবোটে রেখেছেন। ওর অ্যানজাইনাটা এখন অনেকটা কন্ট্রোলে এসেছে। আসলে ডাক্তার সঙ্গে এসেছেন প্ল্যানচেটের জন্য।
আজ রাত্রেও কি আপনাদের প্ল্যানচেট হবে।
আজ হয়তো হবে না, কিন্তু দু-এক’দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।.. কেন বলুন তো?
আমি ইন্টারেস্টেড, বলল ফেলুদা। অবশ্যি উনি আমার উপস্থিতি বরদাস্ত করবেন। কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।
সেটা আমি বলে দেখতে পারি। উনি আপনার প্রতি বেশ প্ৰসন্ন সেটা আমি এর মধ্যেই বুঝেছি। আর এমনিতে প্ল্যানচেটের ব্যাপারে উনি কোনও গোপনতা অবলম্বন করেন। না। যা ফলাফল হয়, সবই তো ওঁর আত্মজীবনীতে যাবে। আমি তো সম্পূর্ণ রেকর্ড রাখছি।