আমার নাম সুশান্ত সোম, ভদ্রলোক ফেলুদাকে নমস্কার করে বললেন—আপনার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীর সঙ্গে আলাপ হল, তাই ভাবলাম সুযোগ যখন মিলেছে তখন আপনার সঙ্গেও আলাপটা সেরে নিই। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। আপনার তদন্তের কথা অনেক পড়েছি। দাঁড়ান, আমার বাসও হয়তো আপনাকে দেখলে খুশি হবেন।
রেস্টোর্যান্টের দরজা দিয়ে আরও দল ঢুকেছে। সুশান্তবাবু তাদের দিকেই এগিয়ে গেলেন। জনা চারেক ভদ্রলোক, তার মধ্যে একজন বেশ বয়স্ক, প্রায় বৃদ্ধ বললেই চলে। সুশান্তবাবু তাঁকে ফিসফিস করে কী বলতে ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ফেলুদা উঠে দাঁড়াল।
বসুন বসুন–উঠছেন কেন? বললেন ভদ্রলোক। আমার নাম সিদ্ধেশ্বর মল্লিক। আমি প্রায় সারা জীবন ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু এই প্রথম একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে দেখলাম।
ফেলুদা বলল, ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত মানে—?
আমি একজন রিটায়ার্ড জজ। বহু অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছি। এখন সে কাজ থেকে অবসর নিয়ে বিশ্রাম করছি। শরীরও কিঞ্চিৎ ভেঙে পড়েছে—সঙ্গে ডাক্তার নিয়ে ঘুরতে হয়। ছেলেও আছে, বেয়ারাও আছে। আর আছে প্রাইভেট সেক্রেটারি। এই ইনি। সুশান্ত খুব কাজের ছেলে। একে ছাড়া চলে না। আমার।
আপনারা শ্ৰীনগরেই থাকবেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
আপাতত। তবে ইচ্ছে আছে কাশ্মীরটা একটু ঘুরে দেখার।
আমাদেরও ওই একই প্ল্যান, বলল ফেলুদা। শ্ৰীনগরে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। আপনারা কি হাউসবোটে থাকবেন?
হ্যাঁ। হাউসবেটটা একটা ইউনিক ধ্যাপার। আমি সিকুটি-ফোরে। একবার এসে থেকে গেছি। ইয়ে, এনার সঙ্গে তো আলাপ হল না–ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর দিকে ফিয়েছেন।
আমিও ক্রাইম, বলল জটায়ু। আমি একজন রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক।
ওরে বাবা! তা হলে তো ক্রিমিন্যাল ছাড়া সবাই উপস্থিত দেখছি…ঠিক আছে। দেখা হবে শ্ৰীনগরে। আমরাও একটু চায়ের ব্যবস্থা দেখি গিয়ে।
০২. শ্ৰীনগর উপত্যকার এক রূপ
আকাশ থেকে শ্ৰীনগর উপত্যকার এক রূপ, আর মাটিতে নেমে আর এক রূপ। চোখ জুড়িয়ে যায় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এও ঠিক যে এ জায়গার সঙ্গে দাৰ্জিলিং-সিমলার কোনও মিল নেই। শ্ৰীনগরের দৃশ্য একেবারে অনন্য। সেটা আরও বেশি করে বুঝতে পারলাম ট্র্যাক্সিতে করে শহরে আসার সময়। শহর থেকে এয়ারপোর্ট সাত মাইল। একবার মনে হয়েছিল উপত্যক বলে বুঝি অনেকটা কাঠমাণ্ডুর মতো হবে, কিন্তু তারপর লেক আর ঝিলাম নদী দেখে সে ধারণা একদম পালটে গেল।
আমাদের যেতে হবে ডাল লেকের দক্ষিণে শহরের রাস্তা বুলেভার্ডে। আধা ঘণ্টায় বুলেভার্ডে পৌঁছে গেলাম। লেকের এদিকটা পাকা গাঁথুনি দিয়ে ঘেরা। ঘাট থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছোট নৌকোয় গিয়ে উঠতে হয়। এই নৌকোকে এখানে বলে শিকার। ভেনিসে যেমন জলপথে যাতায়াতের জন্য গণ্ডোলা, এখানে তেমনি শিকারা। আমাদের হাউসবোটের নাম ওয়াটার লিলি।ওয়াটার লিলির শিকারাও ঘাটেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা মালসমেত তাতে গিয়ে উঠলাম। তারপর পঞ্চাশ হাত খানেক গেলেই পাশাপাশি সার বাঁধা হাউসবোট। এই সারি কিছুদূর যাবার পর লেক চওড়া হয়ে গেছে তারপর আর হাউসবোট নেই। যা আছে সবই লেকের পশ্চিম অংশে।
শিকারা থেকে বোটে উঠতে কোনও কসরতের দরকার হয় না, খুবই সহজ ব্যবস্থা। বোটের সামনের দিকে খানিকটা খোলা জায়গা, সেখানে ইচ্ছা করলে বসা যায়; আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরের ডেকে ওঠার বন্দোবস্ত আছে, সেখানে চেয়ারে বসে চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করা যায়, চা খাওয়া যায়, আর স্রেফ আড্ডাও মারা যায়।
ভিতরে ঢুকলে প্রথমেই বসবার ঘর, তাতে সোফা, চেয়ার, কার্পেট, ইত্যাদি বৈঠকখানার যাবতীয় সরঞ্জাম রয়েছে, দেয়ালে ছবি রয়েছে, ফুলদানিতে ফুল রয়েছে, আবার একটা ছোট লাইব্রেরিও রয়েছে। বসবার ঘরের পরে খাবার ঘর, দুটো বেডরুম, বাথরুম ইত্যাদি। সব মিলিয়ে জলের উপর একটি বাংলো বাড়ি যাতে সব রকম ব্যবস্থা আছে। কিচেনও আছে, তবে সেটা পিছন দিকে একটা ছোট্ট আলাদা নৌকোয়।
লালমোহনবাবুর মুখে হাসি লেগেই আছে, বললেন, ভাগ্যিস ডিসিশনটা নিয়েছিলাম। এর ক্রেডিট কিন্তু সবটাই আমার পাওনা। তোমার দাদা ভূস্বর্গের কথা ভাবেননি।
ফেলুদা বলল, আমি তো আপনার মতো লেখক নই। আইডিয়া আসা উচিত। আপনার মাথা থেকে। যাকগে, এখন আগে একটু চা খেয়ে শিকারায় করে লেকটা একবার ঘুরে দেখা যাক।
দুজন চাকর রয়েছে হাউজবোটের সঙ্গে, নাম মাহমুদিয়া আর আবদুল্লা।
চা খেয়ে বেরোতে সূর্য হেলে এল পশ্চিমে। মে মাস হলে কী হবে, বেশ ঠাণ্ডা; আমাদের কলকাতায় শীতের সময় যে পোশাক পরতে হয়, এখন এখানেও তাই পরতে হয়। ফেলুদা বলল, আজ শুধু লেকটা ঘুরে দেখা যাবে, কাল থেকে সাইট সিইং আরম্ভ হবে। বুলেভার্ডের পিছনেই দেখতে পাচ্ছেন পাহাড় রয়েছে, এক হাজার ফুট উঁচু। ওর মাথায় রয়েছে শঙ্করাচার্যের মন্দির। সম্রাট অশোকের ছেলে জালুকের তৈরি। তা ছাড়া লেকের পুব দিকে মোগল বাগান রয়েছে–নিশাদবাগ, শালিমার, চশমা শাঁহি-এগুলোও দেখা চাই। চশমা শাহির স্ক্রিপ্রং-এর জল নাকি একেবারে অমৃত-যেমনই স্বাদ, তেমনি ক্ষুধাবর্ধক।
লেকের মাঝখানে একটা ছোট্ট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, ওটা কী? আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি জানতাম ফেলুদা কাশ্মীর সম্বন্ধে সব পড়াশুনা করে এসেছে।