তৃতীয় দিন সকাল দশটায় ভাবছি কী করা যায়, এমন সময় ফেলুদার ট্যাক্সি এসে হাজির। আমরা দুজনেই উদ্গ্ৰীব হয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ও হাত তুলে বলল, সবুরে মেওয়া ফলে।
আপনার মাথা পরিষ্কার কি না সেইটে শুধু বলে দিন, বললেন লালমোহনবাবু।
পরিষ্কার, তবে অনেক জট ছাড়াতে হয়েছে। এমন একটা কেস সচরাচর পাওয়া যায় না।
সেটা ইনস্পেক্টর সিং-এর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করতে হবে।
উনি কিন্তু খুনি ধরে ফেলেছেন এর মধ্যেই। মানে?
বেয়ারা প্ৰয়াগ।
সর্বনাশ! তা হলে তো আর সময় নষ্ট করা চলে না। আমি চললাম থানায়।
ফেলুদা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে শহরের দিকে চলে গেল।
ও যখন ফিরল। তখন আমাদের লাঞ্চ খাবার সময় হয়ে গিয়েছে। এসে বলল, আজি তিনটেয় মিটিং। ওঁদের তাঁবুতে।
আমার বুকটা কেঁপে উঠল। ফেলুদার রহস্যোদঘাটন যে না দেখেছে সে কল্পনা করতে পারে না সেটা কত নাটকীয় হতে পারে।
তিনটের পাঁচ মিনিট পরেই পুলিশের জিপ এসে গেল। ইনস্পেক্টর সিং ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, আপনি কি বিশ্বাস করতে পারেন যে একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর ক্রাইম স্টোরির ভক্ত হতে পারে?
আপনি ওসব বই পড়েন নাকি?
ও ছাড়া আর কিছুই পড়ি না। বিশেষ করে প্রাইভেট ডিটেকটিভের গল্প হলে তো আর কথাই নেই। আজ। আপনার রহস্যোদঘাটনের ব্যাপারেও আমার পড়া অনেক গল্পের কথা মনে পড়ছে। অবিশ্যি আপনি যে কী বলতে যাচ্ছেন সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই।
সেটা তো অল্পক্ষেণের মধ্যেই জানতে পারবেন।
তাঁবুতে সকলে জমায়েত। দুটো তাঁবু থেকে চেয়ার এনে সকলের বসবার জায়গা করা হয়েছে। বিজয় মল্লিক, মিঃ সরকার, সুশান্ত সোম, ডাঃ মজুমদার—এঁরা সব চেয়ারে বসেছেন, আর তাবুর এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বেয়ার প্রয়াগ। এই শেষের লোকটির চেহারার মধ্যে একটা ক্লিষ্ট ভাব দেখে মনে হয় পুলিশ তাকে বেশ ভালভাবেই জেরা করেছে।
১০. থ্যাঙ্কস ফর দ্য খোঁচা
ফেলুদা তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একবার সকলের দিকে দেখে নিল। তারপর এক গেলাস জল ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নিয়ে খেয়ে তার কথা শুরু করল–
মিঃ মল্লিক আজ আমাদের মধ্যে নেই, আমি তাঁকে দিয়েই আমার কথা আরম্ভ করছি। সিদ্ধেশ্বর মল্লিক। ত্ৰিশ বছর জজিয়তি করে তারপর কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই রিটায়ারমেন্টের কারণ ছিল অসুস্থতা। তা ছাড়া হয়তো মিঃ মল্লিক। তাঁর পেশায় কিছুটা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। প্ৰাণদণ্ড নিয়ে হয়তো তাঁর মনে একটা সংশয় দেখা দিয়েছিল। আমি এই সিদ্ধান্তের সত্যতা-অসত্যতার ভিতর যেতে চাইছি না। যা ঘটেছিল শুধু তাই বলছি।
মিঃ মল্লিক, দৈনিক ডায়েরি লিখতেন। এই ডায়েরির একটা বিশেষত্ব ছিল। যে দিন তিনি কাউকে ফাঁসির আদেশ দিতেন, সেই দিন ডায়েরিতে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিটির নাম লিখে তার পাশে লাল কালিতে একটা ক্রস দিয়ে দিতেন। আর যে দিন এই দণ্ডের যথার্থতা সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা গভীর সন্দেহ দেখা দিত, সেদিন ক্রসের পাশে একটা প্ৰশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিতেন।
আমি মিঃ মল্লিকের ডায়েরিগুলি দেখেছি। সবসুদ্ধ ছটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। তার মানে ছটি প্রাণদণ্ডের সমীচীনতা সম্পর্কে তিনি সন্দিগ্ধ ছিলেন।
এইবার আমি আরেক দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মিঃ মল্লিকের মনে দ্বন্দ্ব হচ্ছিল কি না হচ্ছিল সেটা সম্বন্ধে জনসাধারণ কিছুই জানতে পারত না। কিন্তু যারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কি মিঃ মল্লিক কখনও ভেবেছিলেন? মনে তো হয় না, কারণ তাঁর ডায়রিতে এর কোনও উল্লেখ নেই। ছেলের মৃত্যুদণ্ডে বাপ-মা কী ভাবছে, বাপের মৃত্যুদণ্ডে ছেলের বা ভাইয়ের বা স্ত্রীর বা অন্য আত্মীয়-স্বজনের কী মনোভাব হতে পারে, সেটা নিয়ে মিঃ মল্লিক বোধহয় কখনও চিন্তা করেননি। কিন্তু আমরা একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারব যে, এই সব প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব অনেকেই নিশ্চয়ই গভীর বেদনা অনুভব করেছে।
এইটো উপলব্ধি করার পরেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে–এই রকম প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত কোনও ব্যক্তির আত্মীয়ই কি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মিঃ মল্লিককে হত্যা করে?
যত ভাবি, ততই মনে হয় এটা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যেখানে দণ্ড সম্বন্ধে জজের মনেও সন্দেহ আছে, সেখানে তো বটেই।
এর পরের প্রশ্ন হচ্ছে—এই ঘরে যারা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে কি এমন ব্যক্তি কেউ আছেন?
এখানে প্রথমেই যাকে বাদ দেওয়া যায়, তিনি হলেন ডাঃ মজুমদার, কারণ তিনি আজ পনেরো বছর হল মল্পিকদের পরিবারিক চিকিৎসক।
বাকি থাকেন। আর চারজন-বিজয় মল্লিক, সুশাস্তু সোম, মিঃ সরকার আর বেয়ারা প্ৰয়াগ।
এখানে বিজয় মল্লিককে এই বিশেষ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁর কোনও আত্মীয়ের প্রাণদণ্ড হয়নি।
সেই রকম সুশান্ত সোমকেও এই একই মর্মে বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাঁরাও কোনও নিকট জনের প্রাণদণ্ডের কথা আমরা ডায়েরিতে পাচ্ছি না।
বাকি রইলেন মিঃ সরকার ও প্রয়াগ বেয়ারা।
এখানে প্ৰয়াগকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।
প্ৰয়াগ চুপ করে দাঁড়িয়ে বইল।
ফেলুদা বলল, প্রয়াগ, সে দিন তুমি যখন নদীতে হাত ধুচ্ছিলে, তখন আমি তোমাকে লক্ষ করছিলাম। তোমার ডান হাতে একটি ছোট্ট উলকি আছে—দুটি ইংরেজি অক্ষর-HR। এটার মানে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই।