কাশ্মীর এসেছিলাম বেড়াতে, আর কীসের থেকে কী হয়ে গেল দেখুন।
কী করবেন বলুন-মানুষের কপালই ওই রকম।
এখন বলুন, আমাকে কী জিজ্ঞেস করতে চান।
আপনি কত বছর পর্যন্ত শ্ৰীনগরে ছিলেন?
বছর বারো।
তারপর কলকাতায় যান?
হ্যাঁ।
সেইখানেই পড়াশুনা করেন?
হ্যাঁ।
আপনার বাবা কি কলকাতাতেও হোটেল ম্যানেজারি করতেন?
হ্যাঁ।
কোন হোটেল
ক্যালকাটা হোটেল।
আপনি গ্র্যাজুয়েট?
বি কম।
এখন কী করেন।
একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে আছি।
কোম্পানির নাম?
ইউনিভারসাল ইনসিওরেন্স।
আপিস কোথায়?
পাঁচ নম্বর পোলক স্ট্রিট।
আপনি জজ মিঃ মল্লিকের কথা জানতেন?
না। এখানে এসে আলাপ। বিজয়ের সঙ্গে অনেক ব্যাপারে মিলে গেল, তাই একটা
আপনি কি জুয়ার ভক্ত?
হঠাৎ কাশ্মীর আসার ইচ্ছে হল কেন?
ক’ দিনের জন্য এসেছেন?
দশ দিন—তবে এখন কী হয় জানি না। এরকমভাবে আটকে পড়বা কে জানত !
আপনার হাতের আংটিটিা একবার দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই।
সরকার তাঁর আংটিটা খুলে ফেলুদার হাতে দিলেন, সোনার আংটি, উপরে একটা ছ কোনা
পাতের উপর মিনে করে নীলের উপর সাদা দিয়ে। S লেখা।
ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে আংটিটা ফেরত দিয়ে দিল।
ঠিক আছে। আপনার জোরা শেষ।
থ্যাঙ্ক ইউ।
০৯. ব্রেকফাস্টের পর ট্যাক্সি নিয়ে শ্ৰীনগরে
পরদিন সকলে ফেলুদা ব্রেকফাস্টের পর ট্যাক্সি নিয়ে শ্ৰীনগরে চলে গেল। বলল, মনে হচ্ছে, পরশু ফিরে আসতে পারব; তবে দু-এক দিন দেরি হলে চিন্তা করিস না।
ন’টা নাগাত পুলিশের জিপ এল, ইনস্পেক্টর সিং নামলেন। অন্য তাঁবুতে কাজ শেষ করে ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
হায়্যার ইজ মিঃ হোমস? হেসে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
আমি বললাম ফেলুদা একটু শ্ৰীনগর গেছে।
এই কেসের ব্যাপারে?
হ্যাঁ।
কিন্তু তার প্রয়োজন হচ্ছে কেন? এই কেস তো জলের মতো সোজা।
কী রকম? বেয়ারাটাই হচ্ছে অপরাধী। তার সুযোগ ছিল। সে একই তাঁবুতে শুত। তা ছাড়া এসব লোকের লোভ হওয়াটা স্বাভাবিক। বেয়ারাগিরি করে আর কত রোজগার হয়?
আপনি কি ওকে অ্যারেস্ট করছেন? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
আপাতত থানায় নিয়ে যাচ্ছি জেরার জন্য। তা ছাড়া, ও যে লেফট হ্যান্ডেড তাও প্রমাণ হয়ে গেছে। ওকে ওর নাম লিখতে বলেছিলাম। ডান হাতে লিখতেই পারল না, কিন্তু বাঁ হাতে বেশ পারল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও অস্বীকার করছে, সুতরাং ওকে বেশ ভাল রকম জেরা করা দরকার।
আংটিটাও পেতে হবে, বললেন জটায়ু।
সেটাও জেরার জোরে বেরিয়ে যাবে। পুলিশের পক্ষে খুঁজে পাওয়া তো মুশকিল। এই পাহাড়ি পরিবেশে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে কে জানে?
ফেলুদা কি তা হলে বৃথাই গেল শ্ৰীনগর? কেসটা এতই সোজা? আমার কিন্তু তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। অত সহজ হলে ফেলুদা অত কাঠখড় পাড়াত না। আমি জানি ও কলকাতায় খোঁজ করবে। ওর লোক আছে যাদের বলে দিলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওরা যে কোনও খবর জোগাড় করে দিতে পারে।
কিন্তু তার পরেই আবার মনে হয়ে যাচ্ছে বেয়ারা লেফট-হ্যান্ডেড।
কিন্তু এত সাহস হবে লোকটার? ও কি জানে না যে ওর ওপরেই প্রথমে সন্দেহ পড়বে?
ইনস্পেক্টর সিং বিদায় নিয়ে প্রয়াগকে সঙ্গে করে চলে গেলেন। লোকটাকে দেখে আমার কষ্ট হল, কারণ ও কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিয়েছে। পুলিশরা স্বীকারোক্তি আদায় করবার জন্য কত কী যে করতে পারে সে আমার জানতে বাকি নেই। ফেলুদাও এ নিয়ে বহুবার আক্ষেপ করে বলেছে। ও বলে পুলিশরা কাজ জানে, ওরা কর্মঠ, কিন্তু দয়ামায়া বলে কিছু নেই ওদের মধ্যে! অবিশ্যি উপায়ও নেই। অনেক সময় জরুরি তথ্য সংগ্ৰহ করতে কড়া রাস্তা নিতে হয়। সে কাজটা প্রাইভেট গোয়েন্দার চেয়ে পুলিশে অনেক বেশি ভাল পারে।
সুশান্তবাবু এবার দেখি আমাদের দিকে আসছেন। বললেন, মিঃ মিত্তির তো বোধহয় শ্ৰীনগর গেছেন।
আমি হ্যাঁ বলতে বললেন, আমরা কিছু না বলতেই উনি আমাদের জন্য এত করছেন, এটা খুব আশ্চর্য বলতে হবে।
আসলে উনি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছেন। রহস্য জিনিসটা ওঁর কাছে অসহ্য। যতক্ষণ না সেটার কিনারা করতে পারছেন, ততক্ষণ ওঁর সোয়াস্তি নেই।
লালমোহনবাবু বললেন, আপনি কি মিঃ মল্লিকের জীবনী লিখতে আরম্ভ করে দিয়েছিলেন?
তা এক রকম দিয়েছিলাম বইকী। খানিকটা করে লিখছিলাম, আর উনি সেটা দেখে দিচ্ছিলেন। খুবই চিত্তাকর্ষক বই হত বলে মনে হয়।
এখন তো কাজটা বন্ধ হয়ে গেল।
তা তো হলই।
আপনিও কি প্ৰয়াগকে সন্দেহ করেন?
মাটেই করিনি। ওর অত সাহস হবে বলেই আমার মনে হয়নি। কিন্তু পুলিশ যেভাবে চলছে…
মিঃ মিত্তিরের উপর আরেকটা অ্যাটেমাট হয়ে গেছে, সেটা বোধহয় জানেন না?
সে কি?
হ্যাঁ। এবার মাথায় বাড়ি মেরেছিল পাথর-টাথর কিছু দিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। কিন্তু কেউ যে ওর উপস্থিতি পছন্দ করছে না, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তা, উনি তো পুলিশ প্রোটেকশন নিতে পারেন।
প্রস্তুত।
আপনাদের তাঁস খেলা বন্ধ বোধহয়? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
মৃত্যুর ছায়া এখনও ঘনিয়ে আছে; এর মধ্যে কি ও সব চলে?
তা বটে।
*
ফেলুদার জন্য প্ৰাণটা ছটফট করছে, অথচ দ্বিতীয় দিনেও ও এল না। দিনটা আমরা সাইট সিইং-এ কাঁটালাম। টুরিস্ট আপিস থেকে খবর নিয়ে আড়াই মাইল দূরে শিকারগী লেক আর এক মাইল দূরে একটা পুরনো শিবমন্দির দেখে এলাম। তাঁবুতে থাকার চেয়ে দূরে থাকাই ভাল বুঝতে পারছিলাম। কারণ তাঁবুকে ঘিরে এখনও খুনের গন্ধ, ভাবতে গেলেই বুক ধড়ফড় করে।