কিন্তু বিজয়বাবুর বেলা তো প্রতিশোধ খাটে না।
তা তো খাটেই না, আর সেই ব্যাপারেই বার বার ধাক্কা খেতে হচ্ছে।
দুপুর বেলা লাঞ্চের পর ফেলুদা বলল, একটু শহরের দিকে ঘুরে আসবে। একটু না হাঁটলে নাকি ওর মাথা খোলে না।
শহর হোক আর যাই হাক, সঙ্গে আপনার অস্ত্রটি রাখবেন, বললেন লালমোহনবাবু।
আমরা দুজন নদীর ধারে গিয়ে বসলাম।
সুশান্তবাবু তাঁবু থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। বিনা মেঘে বজ্ৰাঘাত, বললেন ভদ্রলোক।
আমরাও সায় দিলাম। সত্যিই, এমন যে হবে তা ভাৰতেও পারিনি।
ইনস্পেক্টর কী বলেন? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
সুশান্তবাবু বললেন, যদ্দুর মনে হল, ডাকাতের সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। আংটিটিার বিস্তর দাম ছিল, মাঝখানে হিরে বসানো, তাকে গোল করে পান্না দিয়ে ঘেরা। আর এখানে যে ডাকাতির কেস একেবারে হয় না তা নয়। যত টুরিস্ট বাড়ছে, তত এসবও নাক বাড়ছে। বছর ত্ৰিশোক আগে পাহালগম অনেক নিরাপদ জায়গা ছিল।
আপনারা কি তাঁবুতে বন্দি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না, বললেন সুশান্তবাবু, তবে পাহালগাম ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবে না।
মৃতদেহের সৎকার হবে কখন?
বিকেলের মধ্যেই।
বিকেলে জানতে পারলাম যে, মল্লিকরা ব্ৰাহ্ম ছিলেন। তাই বিজয়বাবুকে আর অশৌচ পালন করতে হবে না।
ফেলুদা পাঁচটার মধ্যে ফিরে এল। ও যতক্ষণ না ফিরছিল। ততক্ষণ আমার অসোয়াস্তি লাগছিল, কিন্তু ও বলল, যারা ওর পিছনে লাগতে পারত, তারা সকলেই এখন পুলিশের নজরে রয়েছে। তাই চিন্তা নেই।
কিন্তু এই যে ঘুরে এলেন, এর কোনও ফল পেলেন?
পেয়েছি বইকী, বলল ফেলুদা, তবে এখানে বসে থেকে সব ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে। না। আমাকে একবার শ্রীনগর যেতে হবে।
কবে যাবেন?
কালই সকলে।
আর আমরা?
আমার দু দিন আন্দাজ লাগবে। সে দু দিন আপনারা এখানেই থাকবেন। চেঞ্জের পক্ষে এর চেয়ে ভাল জায়গা তো আর হয় না।
কিছু আলো দেখতে পেলেন?
তা পেয়েছি। সত্যিই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু এখনও কিছুটা অন্ধকার রয়েছে।
সেই জন্যেই তো শ্ৰীনগর যাওয়া দরকার। তবে যাবার আগে আমার দিক থেকেও কয়েকজনকে একটু জেরা করা দরকার। নিচু স্তর থেকে ওপরে ওঠাই ভাল। আগে প্ৰয়াগকে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।
সুশান্তবাবুকে দিয়ে খবর পাঠাতেই প্রয়াগ তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল।
বোসে এখানে, বলল ফেলুদা।
প্রয়াগ এখন আমাদের তাঁবুতে।
শোনো প্রয়াগ, বলল ফেলুদা, তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি তার ঠিক ঠিক জবাব দেবে।
পুছিয়ে বাবু।
কথাবাতা হিন্দিতেই চলল, আমি বাংলায় লিখছি।
তুমি মল্লিকসাহেবের বাড়িতে কবে থেকে আছ?
পাঁচ বছর হয়েছে।
তার আগে কোথায় ছিলে?
জেকবসাহেবের বাড়িতে বেয়ারার কাজ করতাম। পার্ক স্ট্রিটে।
আমি জেকবসাহেবের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে মক্সিকসাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জেকবসাহেব বিলেত চলে যাচ্ছিলেন, তাই আর আমাকে দরকার লাগছিল না।
মল্লিকসাহেব জেকবসাহেবকে চিনতেন?
ওরা দুজনে এক ক্লাবের মেম্বার ছিলেন।
তোমার পুরো নাম কী?
প্ৰয়াগ মিসির।
তোমার সংসার নেই?
বউ মারা গেছে, মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে।
কাল রাত্রে তুমি কোনও রকম শব্দ পাওনি, যার জন্য তোমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে?
না বাবু।
বাবুকে কে খুন করতে পারে, তাই নিয়ে তোমার কোনও ধারণা আছে?
না বাবু। এ রকম হবে আমি কল্পনাই করতে পারিনি।
ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পার।
এবার ফেলুদা সুশান্তবাবুকে বলল ডাঃ মজুমদারকে খবর দিতে।
ডাঃ মজুমদার এলেন আমাদের তাঁবুতে।
ফেলুদা বলল, আমি আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।
করুন।
মিঃ মল্লিক যেভাবে প্ল্যানচেট করেছিলেন, সেটা কি ডাক্তার হিসাবে আপনার কাছে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়?
ডাঃ মজুমদার মাথা নাড়লেন।
না। আমি ওঁকে অনেকবার বলেছি যে, এই সব পুরনো ব্যপার নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল। আর জজ যদি এক-আধটা ভুল ভার্ডিক্ট দিয়ে থাকে, তাতেই বা কী এসে গেল। ভুল তো সকলেরই হতে পারে।
আপনার নিজের মধ্যে যে ক্ষমতাটা রয়েছে, সেটা কবে থেকে প্রকাশ পেল?
তা অনেক দিন। পাঁচিশ বছর তো বটেই।
ওঁকে কে খুন করতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে?
একেবারেই নেই।
ওঁর ছেলে সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?
ছেলে এক কালে ড্রাগসের প্রভাবে খুব গোলমালের মধ্যে পড়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি। কিন্তু সেই সাধুর প্রভাবেই হাক, আর অন্য কোনও কারণেই হোক, ও একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
জুয়ার প্রতি ওর আসক্তি রয়েছে না?
সেটা সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে পারব না, কারণ আমি ও রসে একেবারেই বঞ্চিত।
ও কোন অফিসে কাজ করে?
চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোং–ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট।
কোথায় অফিস?
গণেশ এভিনিউ। দশ নম্বর।
ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন।
ডাঃ মজুমদার চলে গেলেন। সুশান্তবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন ফেলুদার দিকে।
এবার মিঃ সরকারের সঙ্গে একটু কথা বলব।
মিঃ সরকার?
সুশান্তবাবু যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
ফেলুদা বলল, হ্যাঁ। কেন, আপনার অবাক লাগছে?
উনি তো ঠিক আমাদের দলের মন; এক রকম বাইরের লোক!
তাঁর যে টাকার দরকার নেই সেটা আপনি কী করে জানলেন সুশান্তবাবু? টাকার জন্য মানুষে খুন করে না?
ঠিক আছে। আমি ডাকছি ওঁকে।
মিঃ সরকার এলেন।
আসুন, বসুন, বলল ফেলুদা।