ফেলুদা বলল, আমার মনের ভিতরের জটটা আরও বেশ ভাল করে পাকিয়ে গেল—এই তো ব্যাপার! এখন পুলিশ যদি কিছু করতে পারে।
আপনি নিজে কি হাল ছেড়ে দিলেন?
তা কি হয়? আমি তো প্রথম থেকে সবগুলো ঘটনাই দেখেছি; পুলিশ তো আর তা দেখেনি। অবিশ্যি ঘটনাগুলোর পরস্পরের সঙ্গে কোনও যোগসূত্র আছে কিনা সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। আমাকে যে পাথর ছুড়ে মেরেছিল, আর বিজয়বাবুকে যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল, দুজনেই কি এক লোক? আর সেই লোকই কি এই খুনটা করেছে? হিরের আংটি চুরি যদি মোটিভ হয়ে থাকে, তা হলে হয়তো বাইরের থেকে খুনটা করে থাকতে পারে। কিন্তু–
ফেলুদা চুপ করে গেল। তারপর কিছুক্ষণ পরে বলল, ডাকাতির আইডিয়াটাকে অবিশ্যি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমাদের চেনা লোকই কুকীর্তিটা করেছে।
চেনা লোক বলতে—?
মিঃ মল্লিকের সঙ্গে যারা এসেছেন। ইনকুডিং, মিঃ সরকার। কারণ তাঁর ডান হাতের আঙুলে S লেখা আংটিটার কথা ভুললে চলবে না।
ইনস্পেক্টর সিং তাঁবু থেকে বাইরে বেরোলেন। ভদ্রলোক তিনটে তাঁবুর দিকে দেখিয়ে বললেন, এই সবগুলোই কি একই পার্টির তাঁবু?
বিজয়বাবু বললেন, না; এই দুটো আমাদের, আর ওইটা মিঃ মিত্তিরদের।
মিঃ মিত্তির?
হি ইজ এ ওয়েলনোন প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর ফ্রম ক্যালকাটা।
মিঃ সিং ভুকুঞ্চিত করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, আপনি কি রাজগড়ের খুনের কেসটা সল্ভ করেছিলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
মিঃ সিং হাত বাড়ালেন। করমর্দনের জন্য।
ইনস্পেক্টর বাজপাই ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন। তার কাছে আপনার খুব প্ৰশংসা শুনেছি। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম।
ফেলুদা বলল, আমি কিন্তু এখানে ঘটনাচক্রে এসে পড়েছি। কোনও কেস-টেস সালভ করতে নয়। আপনি আপনাদের কাজ চালিয়ে যান।
আমি তো চালিয়ে যাবই আমার কাজ, কিন্তু আপনিই বা চুপচাপ বসে থাকবেন কেন, বিশেষ করে এই ফ্যামিলির সঙ্গে যখন আপনার আলাপ হয়েছে। খুনটা তো বাইরের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। ছুরি যে বসিয়েছে সে তো লেফট হ্যান্ডেড; এখানে তো সবাই দেখছি রাইট হ্যান্ডেড। যাই হাক, ইউ আর ফ্রি ঢুঁ ক্যারি অন ইওর ওন ইনভেস্টিগেশন।
অনেক ধন্যবাদ। আসলে আমার উপরও একটা অ্যাটেমাট হয়েছিল, কাজেই আমি ব্যাপারটাকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় নিতে পারছি না।
ভাল কথা, মিঃ সিং বিজয়বাবুর দিকে ফিরলেন।ডেড বডির কী হবে? ওটা কি আপনি কলকাতায় নিয়ে যেতে চান?
তার কোনও প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি ছাড়া তো বাবার আর কেউ নেই। মা মারা গেছেন, দাদা বিলেতে ছিলেন, দাদাও মারা গেছেন।
ভেরি ওয়েল, তা হলে এখানেই সৎকার হাক। তবে, বুঝতেই পারছেন, আপনাদের এখনও কিছু দিন পাহালগামে থাকতে হবে। অন্তত যত দিন না কেসটার সুরাহা হচ্ছে তত দিন। কারণ ইউ আর অল আন্ডার সাসপিশন। আমি একে একে প্রত্যেককেই জেরা করতে চাই।
০৮. ঘণ্টা তিনেক ধরে জেরা চালাল
পুলিশ ঘণ্টা তিনেক ধরে জেরা চালাল। জেরা শুরু করার আগে মিঃ সিং ফেলুদাকে দু-একটা প্রশ্ন করে নিলেন। আপনি কাল রাত্রে কোনও সন্দেহজনক শব্দ পাননি?—
না। তা ছাড়া এখানে নদীর শব্দে অন্য সব শব্দ চাপা পড়ে যায়।
জানি। সেটা ক্রিমিন্যালের পক্ষে একটা অ্যাডভানটেজ। ভাল কথা, আপনার বন্ধুর সঙ্গে তো আলাপ হয়নি।
ইনি মিঃ গাঙ্গুলী। হি ইজ এ রাইটার।
এর পর আমরা তিনজন শহরের দিকে গিয়ে একটা রেস্টোরান্টে বসে চা আর আমলেট খেলাম। সকালে গোলমালো আর ব্রেকফাস্ট হয়নি।
খেতে খেতে লালমোহনবাবু বললেন, সবচেয়ে আশ্চর্য দেখছি যে প্রথমে ছেলেকে খুন করতে চেষ্টা করে না পেরে শেষটায় বাবাকে খুন করল।
ফেলুদা বলল, সেটা যে একই লোক করেছে, তার কী গ্যারান্টি? একজনের ছেলের উপর আক্রোশ থাকতে পারে, আরেকজনের বাপের উপর। নাট ভেরি সরপ্রাইজিং।
আমার কিন্তু একটি লোক সম্বন্ধে কী রকম সন্দেহ হয়।
কে?
ডাঃ মজুমদার। এদিকে ডাক্তার, তার উপরে আবার আত্মা নামাচ্ছে। কম্বিনেশনটা অদ্ভুত লাগছে।
খুন করার সুযোগ অবশ্য ডাক্তারেরই বেশি ছিল, কারণ পাশের খাটে ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু মোটিভ কী? হিরের আংটি যদি নেওয়া উদ্দেশ্য হয়, তা হলে বলতে হয় ডাক্তারের খুবই আর্থিক দুরবস্থা। কিন্তু সেরকম তো কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
আর বিজয়বাবু?
বিজয়বাবু অবশ্য তাঁর বাপের মৃত্যুতে খুবই লাভবান হবেন। অবিশ্যি মিঃ মল্লিক। যদি উইল করে থাকেন, এবং সে উইল থেকে যদি ছেলেকে বাদ দিয়ে থাকেন, তা হলে বিজয়বাবুর কোনওই লাভ নেই। তা না হলে বিজয়বাবু মোটা টাকা পাবেন, কারণ মিঃ মল্লিক। নিঃসন্দেহে ধনী ব্যক্তি ছিলেন।
কিন্তু বিজয়বাবু তো তাঁর অফিস থেকে রোজগার কাছেনই। তাঁর হঠাৎ এতটা টাকার দরকার পড়বে কেন যে, সে খুন করবে? খুন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।
দ্যাট ইজ ট্রু।
সুশান্ত সোম সম্বন্ধে কী মনে হয় আপনার?
কাজের ছেলে সে বিষয় কোনও সন্দেহ নেই। আর বেশ কোয়ালিফাইড। মিঃ মল্লিক সুশান্তবাবুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতেন। আর সুশান্তবাবুর কোনও খুনের মোটিভ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
আচ্ছ মিঃ মল্লিকের উপর কি কেউ প্রতিশোধ নিয়ে থাকতে পারে?
তা তো পারেই। আমি তো সেই কথাটাই ধার বার ভাবছি। কত জনের প্রাণ নিয়েছেন লোকটা, ভেবে দেখুন।