লালমোহনবাবু পালস ধরেই বললেন, বেঁচে আছেন—কোনও চিন্তা নেই।
ফেলুদাও নড়েচড়ে উঠল। তার পরেই উঠে বসে মাথার পিছনে হাতটা দিয়ে মুখটা বিকৃত করে বলল, এবার মিস করেনি রে। একেবারে মোক্ষমভাবে লক্ষ্যভেদ।
উঠতে পারবে?
নিশ্চয়ই। ব্যথা তো মাথায়।
ফেলুদা উঠে পড়ে আমাদের দুজনের কাঁধে ভর করে কয়েক পা হেঁটে বলল, ঠিক হ্যায়, হাঁটতে পারব।
কিন্তু কাউকে কি দেখতে পেলেন?
তা হলে তো তদন্ত ফুরিয়ে যেত। সে লোক অত কাঁচা নয়। কটা দিন যাক। আর একটু মাথা না খাটালে চলছে না।
রাত্তিরে মিঃ মল্লিকের তাঁবুতে আবার প্ল্যানচেট হল। বলা হয়নি, এর মধ্যে শ্ৰীনগরে আর এক’দিন প্ল্যানচেট হয়েছিল যাতে আমরাও উপস্থিত ছিলাম। শাসমল বলে এক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আত্মা এসে বলল যে, সে সত্যিই খুন করেছিল।
আজকের প্ল্যানচেটে ফেলুদা ডায়েরি পড়ে যার কথা বলেছিল, সেই কাশ্মীরি মিঃ মনোহর সপুর আত্মা নামানো হল। আশ্চর্য মিডিয়ম ডাঃ মজুমদার-দেশ মিনিটের মধ্যেই আত্মা চলে আসে।
সপুর আত্মা প্রশ্ন করল, আমাকে কেন ডেকেছ?
মিঃ মল্লিক বললেন, তোমাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলাম আমি। যে খুনের মামলার আমি ছিলাম জজ।
সেটা আমি জানি।
আমার বিশ্বাস হয়েছিল খুনটা তুমি করেনি।
খুন করেছিল হরিদাস ভগত। পুলিশ ভুল তদন্ত করেছিল। কিন্তু এখন আর তাতে কিছু এসে যায় না।
কিন্তু আমি যে সেই সেভেনটি এইট থেকে দুশ্চিন্তায় ভুগছি।
তুমি কি আমার কাছে ক্ষমা চাও?
হ্যাঁ।
বেশ, করলাম তোমাকে ক্ষমা। কিন্তু আমার যেসব আত্মীয়বন্ধু জীবিত আছে, তারা তোমায় ক্ষমা করেনি বা করবে না।
তাতে কিছু যায় আসে না। আমি তোমার ক্ষমা চাই।
বেশ, ক্ষমা করলাম। আমি আসি।
প্ল্যানচেট শেষ হল!
মিঃ মল্লিক। আবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
আমরা নিজেদের তাঁবুতে ফিরে এলাম।
বালিশে মাথা রাখার দশ মিনিটের মধ্যেই ঘুম এসে গেল।
০৭. একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে
সকালে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি ফেলুদা। তার মুখের ভাব দেখেই বুঝলাম কোনও একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে।
মিঃ মল্লিক খুন হয়েছেন।
অ্যাঁ।
এবার আমার চিৎকারে লালমোহনবাবুরাও ঘুম ভেঙে গেল।
কাল মাঝরাত্তিরে, বলল ফেলুদা। বুকে ছুরি মেরেছে। শুধু তাই না, খুনটাকে আরও পাকা করার জন্য মাথায়ও একটা ভারী কিছু দিয়ে মেরেছে। সব মিলিয়ে বিশ্ৰী ব্যাপার।
এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। লালমোহনবাবুও উঠলেন। গায়ে দুটো গরম কাপড় চাপিয়ে দুজনেই তাঁবুর বাইরে চলে এলাম। ফেলুদা আমাদের খবরটা দিয়েই আবার বেরিয়ে গেল। মিঃ মল্লিক খুন! ব্যাপারটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনের মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
বাইরে দেখি সকলেই প্রায় তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, সকলেরই মুখ কালো। কথাবাতায় বুঝলাম বিজয়বাবু পুলিশকে খবর দিতে গেছেন। এখান থেকে শহর বেশি দূর নয়, তাই পুলিশ আসতে বেশি সময় লাগা উচিত না।
ডাঃ মজুমদারই সকলে উঠে প্রথমে ব্যাপারটা দেখেন। বিছানার চাদর রক্তাক্ত। সেটা ছুরির আঘাতের ফলে, কারণ মাথায় বিশেষ রক্তপাত হয়নি। অস্ত্ৰটা অবশ্য পাওয়া যায়নি। মনে মনে বললাম, এমন চমৎকার লিন্দর নদী থাকতে অস্ত্র ফেলার জায়গার অভাব কোথায়? নদী এখন সে ছুরিকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে?
তবে শুধু যে খুন তা নয়; তার সঙ্গে চুরিও আছে। মিঃ মল্লিকের ডান হাতের অনামিকায় একটা বহুমূল্য হিরের আংটি ছিল—তাঁর এক গুজরাটি মক্কেলের দেওয়া। খুনি সেইটিও খুলে নিয়ে গেছে।
ফেলুদা ডাঃ মজুমদারকে প্রশ্ন করছিল।
কাল প্লাত্রে ভদ্রলোক শুয়েছেন কখন?
আমাদের অনেক আগে। উনি নটার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়তেন।
আপনি তো ডাক্তার, দেখে বুঝতে পারছেন না। কখন খুনটা হয়েছে?
মনে হয় রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ; তবে সেটা পুলিশের ডাক্তার এলে আরও সঠিকভাবে বলতে পারবে।
রাত্রে কোনও শব্দটব্দ শোনেননি? ঘুমের কোনও ব্যাঘাত হয়নি?
উঁহু। আমার সচরাচর এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে যায়। আমি একটু তাড়াতাড়ি উঠি। সাড়ে ছাঁটায় উঠেই দেখি এই কাণ্ড। আমার আগে প্রয়াগ উঠেছিল, কিন্তু ও এই দুর্ঘটনাটা লক্ষ করেনি। ও উঠেই তাঁবুর বাইরে চলে গিয়েছিল।
কে খুন করতে পারে, সে সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে?
একেবারেই না।
একটা পুলিশের জিপ এসে তাঁবুর কাছে থামল। বিজয়বাবু নামলেন, তাঁর পিছনে একজন ইনস্পেক্টর। বিজয়বাবুর নির্দেশ অনুযায়ী ইনস্পেক্টরটি এগিয়ে গেলেন মিঃ মল্লিকের তাঁবুর দিকে।
আমার নাম ইনস্পেক্টর সিং, বললেন ভদ্রলোক। আমি এই কেসটার চার্জ নিচ্ছি। হোয়্যার ইজ দ্য ডেডবডি?
বিজয়বাবু মিঃ সিংকে নিয়ে তাঁবুর ভিতর ঢুকলেন। আমরা বাইরেই রয়ে গেলাম।
ইনস্পেক্টরের পিছন পিছন। কয়েকজন কনস্টেবল, ফোটোগ্রাফার ইত্যাদি এসব ব্যাপারে। যেমন হয়ে থাকে ঠিক তেমনি ভাবেই কাজ শুরু করে দিল। এ জিনিস অনেকবার দেখেছি, তাই কৌতুহল মিটে গেছে। আর মিঃ মল্লিকের মৃতদেহ দেখবার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। খালি মনে হচ্ছিল—কী আশ্চর্য এই মল্লিক কতজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, আর হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর হত্যাকারীরও মৃত্যুদণ্ড হবে।
ফেলুদা একা এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে দেখে লালমোহনবাবু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,কী ব্যাপার বলুন তো?