টেবিলের পিছনে যিনি বসা তিনিই অবিশ্যি শরৎবাবু। তাঁর মাথায় টাক, কানের পাশে পাকা চুল, ঘন কালো ভুরু, মুখের চামড়া টান। বয়স বোঝা যায় না, শুধু বলা যায় পঞ্চান্ন থেকে পয়ষট্টির মধ্যে।
আপনিই প্রদোষ মিত্তির? ফেলুদার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
আর ইনি হচ্ছেন আমার বন্ধু রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী, বলল ফেলুদা! ওরে বাবা, আপনি তো স্বনামধন্য ব্যক্তি মশাই! আমার বাড়িতে আপনার অনেক ভক্ত আছে!
লালমোহনবাবু বার চারেক হেঁ হেঁ করলেন, তারপর ভদ্রলোক বলতে আমরা চেয়ারে বসলাম। ফেলুদাই কথা শুরু করল।
ইন্দ্রনারায়ণবাবুর বাবা আমাকে তাঁর ছেলের খুনের তদন্ত করতে বলেছেন, সেই জন্যেই আসা।
শরৎবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আমি আর কী বলতে পারি বলুন, শুধু এইটুকুই জানি যে আমাদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছেন ভদ্রলোক। নাটক লিখিয়ে হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু অমন গান কেউ লিখত না, আর কেউ লিখবেও না! আহা-আকাশে হাসিছে চাঁদ, তুমি কেন আনমনা-কী গান! শুধু গান শুনতেই লোকে বার বার ফিরে ফিরে আসে।
আমরা শুনেছি। অন্য দল থেকে তাঁকে প্রলোভন দেখানো হচ্ছিল।
সে তো বটেই। তবে প্রলোভনে কোনও কাজ হয়নি। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ ছিল যে আমাকে ছাড়বার কথা সে কল্পনাও করতে পারত না। যখন প্রথম এল তখন তার বয়স পাঁচিশ। আমিই যে তাকে প্রথম সুযোগ দিয়েছিলাম সেটা সে কোনওদিন ভুলতে পারেনি! শেষটায় তার জীবননাশ করে আমায় খোঁড়া করে দিল।
শরৎবাবু ধুতির খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছলেন। তারপর বললেন, আগে একবার ওর মাথায় বাড়ি মারার চেষ্টা করেছিল রাস্তায়। অবিশ্যি সেটা খুনের চেষ্টা কিনা, আর সেটার সঙ্গে আসল খুনের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, সেটা বলতে পারব না। এই গালিটায় গুণ্ডা বদমায়েশের অভাব নেই। সেদিন ওরা দুজন এসে না পড়লে অন্তত ওর মানিব্যাগটি হাওয়া হয়ে যেত বলে আমার বিশ্বাস। সেটা আর হয়নি। তবে আসল খুনটা যে আমাকেও এক রকম খুন করা সে বিষয় আমার কোনও সন্দেহ নেই! আপনি তদন্ত করতে চান তো বীণাপাণি অপেরায় গিয়ে করুন; আমার নিজের আর কিছু বলার নেই।
আমরা উঠে পড়লাম। ইতিমধ্যে চা খাওয়া হয়ে গেছে সেটা বলে নিই। এর পরের স্টপ হল সুরেশ মল্লিক স্ট্রিট।
আমহাস্ট স্ট্রিট ধরে উত্তরে যেতে গিয়ে বয়ে একটা মোড় নিয়ে তার পরের ডাইনের রাস্তাটাই হল সুরেশ মল্লিক স্ট্রিট। চোদ্দ নম্বরে বীণাপাণির আপিস বার করতে কোনও অসুবিধা হল না!
এখানে বাড়িতে ঢুকেই যাকে বলে উদাত্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বুঝলাম পুরোদমে মহড়া চলছে। ম্যানেজার অশ্বিনীবাবুকে বার করতে সময় লাগল না। বদমেজাজি চেহারা, টুথ ব্রাশ গোঁফ, বছর পঞ্চাশেক বয়স। বাইরের একটা ঘরে আমাদের বসতে দেওয়া হয়েছিল, ভদ্রলোক ঢুকে এসে ফেলুদার কার্ড দেখেই খাপ্পা হয়ে উঠলেন।
এ কি বোসপুকুরের খুনের ব্যাপার নাকি?
ফেলুদা বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার উপর তদন্তের ভার পড়েছে। আপনি ইন্দ্রনারায়ণবাবুর সঙ্গে খুনের রাত্রে দেখা করেছিলেন, তাই আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করার ছিল।
পুলিশ তো এক দফা জেরা করে গেছে, আবার আপনি কেন? তা যাই হাক, আমি বলেই দিচ্ছি, আমি খুনের বিষয় কিছুই জানি না। আমি গোসলুম তাঁকে একটা অফার দিতে আমাদের তরফ থেকে। এর আগেও কয়েকবার গেছি! ওঁকে নিমরাজি করিয়ে এনেছিলাম, কারণ ভারত অপেরা ওঁকে যে টাকা দিত। আমরা তার চেয়ে ঢের বেশি অফার করি। আমাদের সে জোর আছে বলেই করি। কাজেই এ অবস্থায় আমরা যেটা চেয়েছিলাম সেটা হল উনি যাতে আমাদের দলে যোগ দেন। উনি যদি মরেই যান তা হলে আমাদের লাভটা হচ্ছে কোত্থেকে?
অন্য দলের ক্ষতি হলে তাতেওঁ তো আপনাদের লাভ।
না। ওসব ছ্যাঁচড়ামোর মধ্যে আমরা নেই। এ দল সে দল থেকে আর্টিস্ট ভাঙিয়ে নেবার চেষ্টা আমরা সব সময়ই করি, কিন্তু তাতে সফল না হলে কি আমরা সে আর্টিস্টকে প্ৰাণে মেরে অন্য দলের ক্ষতি করব?
আপনি বলছিলেন উনি নিমরাজি হয়েছিলেন। তার কোনও প্রমাণ আছে কি?
গোড়ায় যখন চিঠি লিখে অফার দিই, তার একটা পোস্টকর্ডের উত্তর আছে, দেখতে চান। দেখাতে পারি।
ফেলুদা বলতে ভদ্রলোক ফাইল থেকে পোস্টকার্ডটা বার করে দেখালেন। তাতে দেখলাম ইন্দ্রনারায়ণবাবু সত্যিই বলেছেন, আপনাদের প্রস্তাব আমি ভেবে দেখছি। আপনি মাস খানেক বাদে অনুগ্রহ করে আরেকবার অনুসন্ধান করবেন। অর্থাৎ ইন্দ্রনারায়ণবাবু বীণাপাণি অপেরার প্রস্তাবে পুরোপুরি না করেননি। তাঁর মনে একটা দ্বিধার ভাব এসেছিল।
ফেলুদা বলল, সেদিন রাত্রে যে আপনি গেলেন, তখন আপনাদের মধ্যে কোনও কথা কাটাকাটি হয়েছিল?
আমি ওঁকে নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম সেটা ঠিক আর তাতে হয়তো গলা একআধবার চড়ে যেতে পারে। কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণবাবু মাথা ঠাণ্ডা লোক ছিলেন; সেই কারণেই তাঁর কাজটা এত ভাল হত। উনি বললেন, ভারত অপেরার সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক। সেটা ভাঙা তো সহজ কথা নয়। কিন্তু তাও বলছি আপনারা পারলে আমাকে আর কিছুটা সময় দিন। একটা নতুন নাটক আমি লিখছি ভারত অপেরার জন্য। সেটা দেব বলে কথা দিয়েছি; সে কথার তো আর নড়াচড় করতে পারি না। এই বছরের শেষে আমি আবার আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব—এই হল শেষ কথা। তারপর আমি চলে আসি। তখন পৌনে এগারোটা।…