তাও হতে পারে।
আমার অবিশ্যি এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেটা বোধহয় শনি কি রবিবার করলে ভাল হয়, তাই না?
শনিবার সকালে এলে দু ভাইকেই পাবেন।
আপনি যে কন্দৰ্পনারায়ণের জীবনীর উপর কাজ করছেন, সেটা কতদিন থেকে?
তা প্ৰায় ছমাস হল।
হঠাৎ এই মতি হল কেন?
আমি উনবিংশ শতাব্দী নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব বলে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশুনা করছিলাম। সেই সময় কন্দৰ্পনারায়ণের নাম পাই। খোঁজখবর নিয়ে জানি তাঁর বংশধরেরা এখনও আছেন বোসপুকুরে। সোজা এসে কীর্তিনারায়ণের সঙ্গে দেখা করি। কীর্তিনারায়ণ বলেন—তুমি আমার বাড়িতে থেকে রিসার্চ করতে পারো, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার কিছু কাজও করে দিতে হবে। তার জন্য আমি তোমাকে পারিশ্রমিক দেব। আমি তখন খবরের কাগজের কাজ ছেড়ে এখানে চলে আসি। এখানে অনেক ঘর খালি পড়ে আছে, তারই একটা ঘরে আমাকে এক তলায় থাকতে দেন কীর্তিনারায়ণ। গত ছমাসে আমি এবাড়ির সঙ্গে বেশ মিশে গেছি। আমার কারবার অবিশ্যি শুধু কীর্তিনারায়ণকে নিয়েই, তবে অন্যরাও আমার ব্যাপারে কোনও আপত্তি করছেন বলে শুনিনি।
ভাল কথা–
ফেলুদা তার পার্স থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ বার করল।
এটা বোধহয় সেদিন আপনার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল—আপনি যখন ঘাম রুমাল বার করেন। জন্মদিনের জন্য কেকের অর্ডার কি, নাকি টেলিগ্রাম?
ফেলুদা হ্যাপি বাথর্ডে হুকুম চাঁদ লেখা কাগজটা প্ৰদ্যুম্নবাবুর হাতে দিল। প্ৰদ্যুম্নবাবু ভুরু কপালে তুলে বললেন, কই, এমন তো কোনও কাগজ আমার পকেটে ছিল না। আর এই হুকুম চাঁদ যে কে সে তো আমি বুঝতেই পারছি না।
আপনি সেদিন কীসে করে আমার বাড়িতে এসেছিলেন?
বাস।
বাসে ভিড় ছিল? তার মধ্যে কেউ এটা পকেটে ফেলে দিতে পারে?
তা পারে, কিন্তু এটার তো কোনও মানেই আমি বুঝতে পারছি না।
এটা যদি আপনার না হয় তো আমার কাছেই থাকুক।
ফেলুদা কাগজটা আবার পার্সে রেখে দিল। এই কাগজ যে একটা রহস্যের মধ্যে পড়ে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
০৫. বোসপুকুর গিয়েছিলাম
আমরা বোসপুকুর গিয়েছিলাম বিষ্যুদবার, আবার যেতে হবে শনিবার, কাজেই মাঝে শুকুরবারটা ফাঁক। সেই ফাঁকে দেখি লালমোহনবাবু আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। আসলে একটা তদন্তু যখন শুরু হয়ে যায়। তখন আর নিয়ম মানা যায় না।
ভদ্রলোক এসেই ধাপ করে সোফায় বসে বললেন, আপনার তো শুধু বোসপুকুর গেলে চলবে না মশাই-যাত্রা পাটিগুলোতেও তো একবার যাওয়া দরকার।
সে আর বলতে, বলল ফেলুদা।মৃত ব্যক্তির সমস্ত জীবনটাই তো যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন বাড়িতে বসে না গেজিয়ে চলুন মহম্মদ শফি লেনটা ঘুরে আসা যাক।
তারপর বীণাবাণি অপেরার ম্যানেজার সেই ঈশানবাবু না কি-
আশ্বিনীবাবু! হ্যাঁ। অশ্বিনীবাবুর সঙ্গে তো কথা বলতে হবে। তাই না?
নিশ্চয়ই। তোপ্সে, একবার ডিরেকটরিতে দ্যাখ তো বীণাপাণি অপেরার ঠিকানাটা কী।
ডিরেকটরি দেখতে বেরোল বীণাপাণি অপেরা সুরেশ মল্লিক স্ট্রিটে। লালমোহনবাবু বললেন যে রাস্তাটা ওঁর জানা আছে। ওখানের একটা ব্যায়ামাগারে নাকি উনি কলেজে থাকতে রেগুলারলি যেতেন।
বলেন কী! বলল ফেলুদা।
বিশ্বাস করুন। ডুন বৈঠক বারবেল চেস্ট-এক্সপ্যান্ডার কোনওটা বাদ দিইনি। বডির ডেভেলপমেন্টও হয়েছিল ভালই; আমার হাইটু বেয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি নেহাত নিন্দের নয়।
তা সে সব মাংসপেশি গেল কোথায়?
আর মশাই, লেখক হলে কি আর মাসল থাকে শরীরে? তখন সব মাসল গিয়ে জমা হয় ব্রেনে। তবে ভোরে হাঁটার অভ্যোসটা রেখেছি। ডেইলি টু মাইলস। তাই তো আপনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারি।
চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবুর খুব উৎসাহ। খুনের ব্যাপারটা কাগজে পড়েছেন, তা ছাড়া ভারত অপেরার অনেক যাত্রা ওঁর দেখা। আমরা সেই খুনেরই তদন্ত করছি জেনে বললেন, ইন্দ্ৰ আচায্যি এক ভারত অপেরাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর খুনিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করতে পারলে একটা কাজের কাজ হবে।
শুক্রবার ট্র্যাফিক প্রচুর, তাই ভারত অপেরার আপিসে পৌঁছতে লাগল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নম্বরটা ডিরেকটরিতে দেখে নিয়েছিলাম, তা ছাড়া দরজার উপরে সাইন বোর্ডে লেখাই রয়েছে কোম্পানির নাম।
দরজা দিয়ে ঢুকে একটা টেবিলের পিছনে একজন কালো মতন মাঝবয়সী লোক বসে আছেন; বললেন, কাকে চাই?
ফেলুদা তার কার্ডটা বার করে দেখাতে ভদ্রলোকের চোখের অলস চাহনিতে কিছুটা জৌলুস এল। বললেন, আপনারা কি শরৎবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন—আমাদের প্রোপাইটার?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বলল ফেলুদা।একটু বসুন। একটা বেঞ্চি আর আরও একটা চেয়ার ছিল ঘরটায়, আমরা তাতেই ভাগাভাগি করে বসলাম। ভদ্রলোক উঠে পিছনের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। লালমোহনবাবু বললেন, এই কোম্পানির যে এত রমরমা সেটা কিন্তু এঘর থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই।
মিনিট খানেকের মধ্যেই ভদ্রলোক ফিরে এসে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। শরৎবাবু দোতলায় বসেন।
একটা সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় হারমোনিয়ামের শব্দ পেলাম। রিহার্সলের তোড়জোড় চলছে নাকি? খুঁটি চলে গেলেও যাত্ৰা তো চালিয়েই যেতে হবে।
প্রোপাইটার শরৎ ভট্টাচার্যির আপিস দেখে কিন্তু ধারণা পালটে গেল। বেশ বড় ঘর, বড় টেবিল, চারপাশে মজবুত চেয়ার, দেয়ালে একটা বিরাট বারোমাসি ক্যালেন্ডার, আর্টিস্টদের বাঁধানো ছবি, দুটো আলমারিতে মোটা মোটা খাতপত্র ছাড়া একটা গোদারেজের আলমারি রয়েছে, মাথার উপর বঁাই বাঁই করে ঘুরছে পাখা।