কই, কিনি গোয়েন্দা মশাই?
ফেলুদা নিজের, এবং সেই সঙ্গে আমাদের দুজনের পরিচয় দিয়ে দিল। লালমোহনবাবুর পরিচয় পেয়ে কীৰ্ত্তিনারায়ণ চোখ কপালে তুললেন। কই, আপনার লেখা কোনও রহস্য গল্প তো কোনওদিন পড়িনি!
লালমোহনবাবু ভীষণ বিনয় করে বললেন, আজ্ঞে সে সব আপনার পড়ার মতো কিছুই না। তবু, রহস্য গল্প যখন লেখেন তখন আপনার মধ্যেও একটি গোয়েন্দা নিশ্চয়ই বর্তমান। দেখুন, আপনারা দুজনে মিলে এই রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারেন। কিনা। ইন্দ্র ছিল আমার ছোট ছেলে। যা হয়, কনিষ্ঠ সন্তান অনেক সময়ই একটু নেগলেকটেড হয়। ওর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, কিন্তু তার জন্য ও কোনওদিন অভিযোগ করেনি বা কুপথে যায়নি। গান-বাজনা ভালবাসত, পড়াশুনা যখন হল না। তখন ভাবলুম ওদিকেই যাক। ছোট বয়স থেকেই গান লিখত, নাটক লিখত, বেহালা বাজাত। বাড়িতে বেহালা ছিল ঠাকুরদাদার আনা বিলেত থেকে, আম আটির ভেঁপু—
আম আঁটির ভেঁপু? ফেলুদা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
ওই রকমই রসিকতা ছিল ঠাকুরদার, বললেন কীৰ্ত্তিনারায়ণ, বেহালাকে বলতেন। আম আঁটির ভেঁপু, প্রথম ল্যাগন্ডা মোটর গাড়ি যখন কিনলেন তখন সেটাকে বলতেন পুষ্পক রথ, গ্রামোফোন রেকর্ডকে বলতেন। সুদৰ্শন চক্ৰ—এই আর কী। ঠাকুরদাদার কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। আসল কথা হচ্ছে কী, ইন্দ্রর এই ভাবে জীবন শেষ হয়ে যাওয়াতে আমি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি। যাত্রায় যোগ দেওয়াটা আচাৰ্য বাড়ির ছেলের পক্ষে কিছু গৌরবের নয় ঠিকই, কিন্তু শেষের দিকে সে মাইনে পেত পনেরো হাজার টাকা; এটাও তো দেখতে হবে! তার মধ্যে গুণ না থাকলে এটা কি হয়? আমি নিজে যাত্ৰা থিয়েটারের খুব ভক্ত ছিলাম। এক রকম নেশা ছিল বলতে পার। সেখানে আমার নিজের ছেলে সে লাইনে গেলে নাক সিটিকোলে চলবে কেন? না, ইন্দ্ৰকে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। আর সে সেটার সদ্ব্যবহার করে পুরোপুরি। যাত্রার কাজ করেও তার মধ্যে কোনও বদ খেয়াল দেখা দেয়নি। কাজ-পাগলা মানুষ ছিল সে। বেহালায় হাত ছিল চমৎকার, গান লিখিত রীতিমতো ভাল। আমার মতে আচাৰ্য বংশের সে কোনও রকম অসম্মান করেনি; বরং একদিক দিয়ে দেখলে মুখ উজ্জ্বলই করেছে।
ফেলুদা বলল, আপনি কি জানেন যে দিন পনেরো আগে মহম্মদ শফি লেনে তাঁকে একজন এসে পিছন থেকে আঘাত করে, এবং সে আঘাত কাঁধে না পড়ে মাথায় পড়লে তিনি হয়তো তখনই মারা যেতেন?
তা জানি বইকী, বললেন কীর্তিনারায়ণ।আমিই তো তাকে তোমার পরামর্শ নিতে বলি।
এবার যে ঘটনাটা ঘটিল, আপনার মতে কি তার জন্যও এই যাত্রার দলগুলির মধ্যে রেষারেষিই দায়ী?
সে তো আমি বলতে পারব না। সেটা বার করার দায়িত্ব তোমার। তবে এটা বলতে পারি যে ইন্দ্রর শত্ৰু যদি থেকে থাকে তো সে যাত্রার দলেই হয়তো থাকবে? এমনিতে সে বিশেষ কারুর সঙ্গে মিশত না, আর সম্পূর্ণ নির্বিবাদী লোক ছিল। বললাম না, সে যে জিনিসটা জানত সেটা হল কাজ। কাজের বাইরে তার আর কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না।
পুলিশ তো বোধহয় বাড়ির সকলকে জেরা করেছে?
তা তো করবেই। সেটা তো তাদের রুটিনের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু তারা করেছে বলে তুমি করতে পারবে না। এমন কোনও কথা নেই। এখন অবিশ্যি তুমি আমার অন্য ছেলেদের পাবে না! সন্ধ্যায় এলে পাবে। প্ৰদ্যুম্ন এখন আছে, তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারো। চাকর-কেয়ারারা আছে। আমার এক বউমা আছেন, হরিনারায়ণের স্ত্রী। বড় ছেলে দেবনারায়ণ বিপত্নীক। হরিনারায়ণের মেয়ে লীনা আছে। সে খুব চালাক-চতুর। ইন্দ্রর খুব ন্যাওটা ছিল। ভাল কথা, তোমার ফি কত?
আমি আগাম হাজার টাকা নিই, তারপর তদন্তু ঠিক মতো শেষ হলে পর আরও হাজার নিই।
রহস্যের সমাধান না হলে আগামটা ফেরত দেওয়া হয়?
আজ্ঞে না, তা হয় না।
ভেরি গুড। আমি তোমাকে হাজার টাকার চেক লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দোহাই বাপু-আমি কোনদিন ফস করে চলে যাব-একে ডায়বেটিস, তার উপর একটা ষ্ট্রোক হয়ে গেছে -যাবার আগে ইন্দ্রের খুনির শাস্তি হয় এটা আমি দেখে যেতে চাই।
শুধু একটা প্রশ্ন করার বাকি আছে।
বলো।
হুকুম চাঁদ বলে কি আপনার বন্ধুস্থানীয় কেউ আছে?
হুকুম সিং বলে একজনকে চিনতাম, তা সে অনেক’দিন আগে।
থ্যাঙ্ক ইউ।
ফেলুদা প্ৰদ্যুম্নবাবুর সঙ্গেই আগে কথা বলা স্থির করল। কীর্তিনারায়ণবাবু উঠে চলে যেতেই প্ৰদ্যুন্নবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোক প্রথম কথাই বললেন, দারোগা সাহেব একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান!
কে, মিস্টার পোদ্দার?
হ্যাঁ, উনি নীচে আছেন।
আমরা তিনজন নীচে রওনা দিলাম। লালমোহনবাবু এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, তবে বুঝতে পারছিলাম যে উনি সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। বিভিন্ন লোকে কী ভাবে কথা বলে। সেদিকে নাকি লেখকদের দৃষ্টি রাখতে হয়, তা না হলে গল্পে ভাল ডায়ালগ লেখা যায় না। তা ছাড়া কিছুদিন আগেই লালমোহনবাবু এক’দিন আমাদের বাড়িতে আড্ডা মারতে মারতে বলেছিলেন, শোনো ভাই তপেশী, তোমার দাদাকে কিন্তু আমরা তদন্তের ব্যাপারে যতটা সাহায্য করতে পারি ততটা করি না। এবার থেকে আমরাও চোখ-কান খোলা রাখব। শুধু দর্শকের ভূমিকা নেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়-বিশেষ করে আমি নিজেই যখন গোয়েন্দা কাহিনী লিখি!
মণিলাল পোদ্দার ফেলুদাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, গন্ধে গন্ধে ঠিক এসে হাজির হয়েছেন দেখছি।