শুনুন অশ্বিনীবাবু! আমার আর দু-তিনদিন লাগবে এই নাটকটা শেষ করতে। আমি এখন আর কিছু ভাবতে পারছি না। আপনি সামনের সপ্তাহে আর একটিবার আসুন।
ভরসা দিচ্ছেন কিছুটা?
একেবারে নিরাশ করার ইচ্ছে থাকলে আর আপনাকে আসতে বলব কেন? তবে আমার দিকটাও আপনার চিন্তা করে দেখতে হবে। টাকাটাই যে সব সময় সব থেকে বড় জিনিস তা তো নয়। ভারত অপেরা যদি জানে যে আপনারা আমাকে বিশ অফার করছেন, তা হলে আমার বিশ্বাস তারাও আমাকে ওই টাকাই দিতে চাইবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে—এত বছরের সম্পর্ক কি চট করে ভোলা যায়?
ঠিক আছে। তা হলে তো এখন আর কথা বলে লাভ নেই। দিন সাতেক পরে এলে আশা করি ফল হবে। এভাবে ঝুলিয়ে রাখাটাও কোনও কাজের কথা নয়, ইন্দ্ৰবাবু! আসি। নমস্কার।
নমস্কার।
ইন্দ্রনারায়ণ ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের দরজার দিকে কিছুদূর এগিয়ে দিলেন। অশ্বিনীবাবুকে। তারপর নিজের কাজের ঘরে ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসলেন। শেষ দৃশ্যটা ভালই যাচ্ছে। এভাবে একেবারে শেষ পর্যন্ত গেলে এ নাটককে কেউ রুখতে পারবে না। এটা হবে ইন্দ্রনারায়ণ আচার্যের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।
ইন্দ্রনারায়ণ এক মনে কাজ করে চলেছেন। মাঝে মাঝে দু-একটা শ্যামা পোকা আসছে। সামনে পুজে। এই পোকাই তাঁর কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যাঘাতের সৃষ্টি করে। আর লোডশেডিং। তবে আজ ক’দিন থেকে লোডশেডিং হচ্ছে না!! আশা করি সামনের দুটো দিনও হবে না।
ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর পুরো মনোযোগটা লেখায় দিলেন। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ নাটক। সম্রাট অশোক।
কিন্তু কাজ বেশি দূর এগোতে পারল না। ইন্দ্রনারায়ণ টেরও পেলেন না যে একটি লোক ঘরে ঢুকে অতি সন্তৰ্পণে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
তারপর হামানদিস্তার একটি মোক্ষম বাড়ি। আর ইন্দ্রনারায়ণের চোখের সামনে সব কিছু চিরতরে অন্ধকার হয়ে গেল!
০৩. খবরের কাগজ খুলে চমকে উঠলাম
খবরের কাগজ খুলে চমকে উঠলাম।
ইন্দ্রনারায়ণ আচার্য তাঁর বাড়িতে খুন হয়েছেন। গত পরশু রাত্রে হয়েছে ঘটনাটা। খবরে যাত্রায় ইন্দ্রনারায়ণের ভূমিকা সম্বন্ধেও কয়েক লাইন লিখেছে। আশ্চর্য দশ দিনও হয়নি ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি এসেছিলেন ফেলুদার সঙ্গে দেখা করতে।
ফেলুদা অবিশ্যি আমার আগেই খবরটা পড়েছে। আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, লোকটা এল আমার কাছে, অথচ কিছু করতে পারলাম না। ওর জন্য। অবিশ্যি করার কোনও উপায়ও ছিল না।
আমার একটা ব্যাপারে খটকা লাগছিল। বললাম, প্রথমবার ভদ্রলোককে গলিতে অ্যাটাক করেছিল, আর এবার একেবারে বাড়ির ভিতর এসে খুন করল। খুব ডেয়ারিং খুনি বলতে হবে।
ফেলুদা বলল, সেটা ওঁর বাড়ির প্ল্যান, ভদ্রলোক কোন ঘরে থাকতেন, ইত্যাদি না দেখে বলা যাবে না। আর খুন করার তেমন তাগিদ থাকলে বাড়িতে এসে করবে না কেন?
কিন্তু এবার তো আর তোমাকে তদন্তর জন্য ডাকল না।
এবারে পুলিশকেই ডেকেছে বোঝা যাচ্ছে। তবে ও পাড়ার থানার দরোগা মণিলাল পোদারকে তো বেশ ভাল করে চিনি। এক তিনি যদি কোনও খবর দেন।
মণিলাল পোদ্দারকে আমিও একবার দেখেছি। মোটাসোটা গুফো ভদ্রলোক, ফেলুদাকে যেমন ঠাট্টাও করেন তেমনি শ্রদ্ধাও করেন।
তবে শেষ পর্যন্ত খবরটা এল দারোগার কাছ থেকে নয়; স্বয়ং আচাৰ্য বাড়ির কর্তা উনআশি বছরের বুড়ো কীর্তিনারায়ণ ফেলুদাকে ডেকে পাঠালেন। খুনটা হবার তিন দিন পরে সকালে নটা নাগাত এক ভদ্রলোক এলেন আমাদের বাড়িতে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, বেশ শার্প চেহারা, চোখে সোনার চশমা। অক্টোবর মাস হলেও বেশ গরম, ভদ্রলোক সোফায় বসে রুমাল বার করে ঘাম মুছে বললেন, কিছু মনে করবেন না, মিঃ মিত্তির; বহুবার চেষ্টা করেও আপনার লাইন পেলাম না। আমি আসছি বোসপুকুরের আচার্য বাড়ি থেকে। আমায় পাঠিয়েছেন বাড়ির কর্তা কীর্তিনারায়ণবাবু! আমাদের বাড়িতে একটা খুন হয়েছে জানেন বোধহয়। সেই ব্যাপারে যদি আপনার সাহায্য পাওয়া যায়।
আপনার পরিচয়টা…?
এই দেখুন, আসল কথাটাই বলা হয়নি। আমার নাম প্ৰদ্যুম্ন মল্লিক। আমি ও বাড়িতে থেকে বংশের আদিপুরুষ কন্দৰ্পনারায়ণের একটা জীবনী লিখছি। লেখাই আমার পেশা। একটা খবরের কাগজে চাকরি করতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। আপাতত জীবনীর জন্য তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে কীর্তিনারায়ণের সেক্রেটারির কাজ করছি। উনি ব্যারিস্টার ছিলেন; রিটায়ার করেছেন বছর চারেক হল। ওঁর শরীরটা বিশেষ ভাল নেই।
আমাকে ডাকতে এসেছেন—পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি?
পুলিশ যা করার করছে, কিন্তু কীর্তিনারায়ণের পছন্দ-অপছন্দ একটু গতানুগতিকের বাইরে। পুলিশকে ডেকেছে। ওঁর ছেলেরা। উনি নিজে আপনার কথা বললেন। বললেন পুলিশের চেয়ে একজন ভাল প্ৰাইভেট ডিটেকটিভ নিয়োগ করলে কাজ হবে বেশি। উনি আবার গোয়েন্দা কাহিনীর বিশেষ ভক্ত। আপনার যা পারিশ্রমিক তাও উনি দিতে রাজি আছেন। অবশ্যই।
ইতিমধ্যে খুন সম্বন্ধে আর কোনও তথ্য পাওয়া গেছে?
বিশেষ কিছুই না। খুনটা মাথার পিছন দিকে বাড়ি মেরে করা হয়। ইন্দ্রনারায়ণ তখন টেবিলে বসে কাজ করছিলেন। পুলিশের ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন যে খুনটা হয় রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে। ইন্দ্রনারায়ণের ঘর ছিল বাড়ির এক তলায়। একটা শোবার ঘর আর তার পাশে একটা কাজের ঘর। উনি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতেন। উনি যে যাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সে খবর জানেন বোধহয়?