একটা কুকুরের ডাকে আরেকটা সাড়া দিয়েছে এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ আমার হাঁটুতে একটা হাত রাখল।
একটা লোক আসছে গলির পশ্চিম দিক থেকে। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, তার উপর একটা ছেয়ে রঙের চাদর জড়ানো। চাদর আমাদের গায়েও আছে, কারণ অক্টোবর মাসের রাত্তিরে বেশ চিনচিনে ঠাণ্ডা।
লোকটা আমাদের ছাড়িয়ে চলে গেল অন্য ফুটপাথ দিয়ে। সে হাঁটছে আচার্য বাড়ির গা ঘেঁষে।
এবার সে দরজার কাছাকাছি পৌঁছে হাঁটার গতি কামাল।
তারপর দরজার সামনে এসে থামল।
ঠক্ ঠক্ ঠক্…
তিনটে মৃদু টোকা দরজার উপর। কান পেতেছিলাম বলে শব্দটা শুনতে পেলাম। দরজা খুলে গেল। অল্প ফাঁক, ঠিক যাতে একটা মানুষ ঢুকতে পারে। মানুষটা ঢুকে গেল। যে ঢুকাল তাকে আমরা তিনজনেই চিনি।
ইনি হলেন বীণাপাণি অপেরার ম্যানেজার অশ্বিনী ভড়।
ঘড়িতে ঢং ঢেং করে বারোটা বাজল।
অর্থাৎ অশ্বিনীবাবু ঢোকার পর পনেরো মিনিট হয়ে গেছে।
এবার ভদ্রলোক বেরোলেন। তাঁর সঙ্গে যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই, কারণ হাত দুটো চাদরের নীচে।
ভদ্রলোক যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিক দিয়েই আবার চলে গেলেন।
আমাদের পাহারা সার্থক এবং শেষ। এই দানটা খেলে উঠব, ফেলুদা ফিসফিস করে বলল। পরদিন সকালে ফেলুদা বাসপুকুরে ফোন করল প্ৰদ্যুম্নবাবুকে। আমি বসবার ঘরে মেন টেলিফোনে কান লাগিয়ে কথা শুনলাম।
কে, মিস্টার মল্লিক?
হ্যাঁ, কী খবর?
কাল রাত্রে কিছু হয়নি তো?
কই, না তো।
এক কাজ করুন; আমি ফোনটা ধরছি, আপনি একবার ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাজের ঘরে গিয়ে দেখে আসুন তো সব ঠিক আছে কিনা।
আধ মিনিটের বেশি ধরতে হল না। এবারে প্রদ্যুম্নবাবুর গলার স্বর একেবারে বদলে গেছে।
ও মশাই, সর্বনাশ হয়ে গেছে!
কী হল?
সব নতুন নাটক আর গান হাওয়া!
আমি আন্দাজ করেছিলাম বলেই ফোন করলাম।
এর মানেটা কী?
অন্য রহস্যগুলোর সঙ্গে আরেকটা যোগ হল।
আপনি কি আজ একবার আসছেন?
প্ৰয়োজন হলে যাব। তার আগে দারোগা সাহেবের সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে।
ফোনটা রেখে ফেলুদা মণিলাল পোদারের নম্বর ডায়াল করল।
শুনুন মিঃ পোদ্দার, গলি থেকে আপনার লোক সরিয়ে নেবার জন্য ধন্যবাদ। কাল সত্যিই কাজ হয়েছে। আপনি অশ্বিনীবাবুর দিকে দৃষ্টি রাখছেন তো? উনি কিন্তু কাল রাত বারোটায় আচার্য বাড়িতে গিয়ে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর বহুমূল্য সব কাগজপত্র সরিয়ে নিয়ে গেছেন।
লোকটা খুব গোলমেলে, বললেন মিঃ পোদ্দার।খুনের টাইমের জন্য। ওর কোনও অ্যালিবাই নেই। সেদিন রাত্রে আচার্য বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফেরেনি। বলছে পথে ট্যাক্সি বিগড়ে যায় বলে আটকে পড়েছিল, কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপনার প্রোগ্রেস কেমন?
মোটামুটি ভালই। অবিশ্যি আমরা তো ঠিক এক রাস্তায় চলছি না, তাই আমার সিদ্ধান্তগুলো আপনার সঙ্গে মিলবে না।
তা না মিলুক। যে কোনও রকমে রহস্যের সমাধান হলেই হল।
ফেলুদা কোন রাস্তায় চলছে সেটা জানতে চাইলে উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই আর আমি ওদিকে গেলাম না। ফেলুদা ফোন রেখে বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি। স্টেটসম্যানের পার্সেনাল কলামে একটা জরুরি বিজ্ঞাপন দিতে হবে। একটা ভাল বেহালার দরকার।
স্টেটসম্যানে পরদিনই বেরোল যে একটা উৎকৃষ্ট বিদেশি বেহালার প্রয়োজন, অমুক বক্স নাম্বারে লিখে খবর জানানো হোক।
এই বিজ্ঞাপনের উত্তর এসে গেল দুদিনের মধ্যে। চিঠিটা পড়ে ফেলুদা বলল, আমাকে একটু লাউডন স্ট্রিটে যেতে হচ্ছে, বিশেষ দরকার।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসে ফেলুদা বলল, বেজায় দাম চাইছে।
আমি বললাম, এনসাইক্লোপিডিয়া পড়ে তোমার কি এই বয়সে বেহালা শেখার শখ হল?
ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, ইট ইজ নেভার টু লেট টু লার্ন।
অর্থাৎ আরও রহস্য।
এদিকে লালমোহনবাবুও ঘন ঘন আসছেন আর ছটফট করছেন। একবার আমায় একা পেয়ে বললেন, তোমার দাদার সব ভাল শুধু এক এক সময় চুপ মেরে যাওয়ার ব্যাপারটা মোটে করদাস্ত করা যায় না।
বুধবার পার্সেনাল কলামে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, শুক্রবার উত্তর পেয়ে ফেলুদা লাউড়ন স্ট্রিটে গিয়েছিল, শনিবার সকালে দেখি ওর চেহারা একদম পালটে গেছে। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে বলল, আজি আচার্য বাড়ি যেতে হবে, কীর্ত্যিনারায়ণকে এখুনি ফোন করা দরকার।
কীৰ্তিনারায়ণ ফোন পেয়ে বললেন, আপনার কাজ কি মিটে গেছে!
তই তো মনে হচ্ছে, বলল ফেলুদা, তবে সেটা সম্পূর্ণ মিটবে একটা মিটিং করে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বললে পরে। আর সেই বলাটা বলতে হবে সকলের সামনে। অন্তত আপনি, আপনার দুই ছেলে, আর প্রদ্যুন্নবাবুকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।
সেটা আর এমন কঠিন কী? এরা তো সবাই বাড়িতেই আছে। সে ব্যবস্থা আমি করছি; আপনি চিন্তা করবেন না। কটায় আসছেন?
এই ধরুন দশটা।
কীর্তিনারায়ণের পর মণিলাল পোদ্দারকে ফোন করে ফেলুদা দশটায় বোসপুকুরে আসতে বলল।
লালমোহনবাবু এলেন নটায়, আমরা সাড়ে নটায় চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আচাৰ্য বাড়িতে পৌঁছে দেখি দারোগ সাহেব এসে গেছেন। ফেলুদা বলল, আজই ঘটনার ক্লাইম্যাক্স, অতএব আপনার থাকার প্রয়োজন।
দোতলায় যে বৈঠকখানায় প্রথম দিন কীর্তিনারায়ণের সঙ্গে কথা হয়েছিল, আজও সেখানেই ব্যবস্থা হয়েছে।
আমরা আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কীর্তিনারায়ণ এসে গেলেন।
কই, এদের সব ডাকো, প্ৰদ্যুম্ন।