এবারে সেটার কোনও সম্ভাবনা নেই!
কেন?
কারণ আমরা তিনজনেই যাব ছদ্মবেশে।
ওঃ, দুৰ্দান্ত ব্যাপার মশাই! আমাকে একটা ফ্রেঞ্চকার্ট দাড়ি দিতে পারবেন?
আমি মনে মনে তাই ভাবছিলাম।
গ্রেট!
মেক-আপে ফেলুদার জুড়ি নেই সেটা আগেও বলেছি, কিন্তু এতদিন শুধু ওর নিজের মেকআপই দেখেছি, এবার ও আমাকে আর লালমোহনবাবুকে যেভাবে মেক-আপ করল তাতে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেরাই হকচাকিয়ে গেলাম। লালমোহনবাবুকে ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি আর ঢেউ খেলানো চুল, আর আমার গোঁফ দাঁড়ি আর পার্ক স্ট্রিট-মাক ঝাঁকড়া চুলের কোনও তুলনা নেই।
ফেলুদা নিজে একটা চাড়া দেওয়া মিলিটারি গোঁফ লাগিয়েছে, আর একটা পরচুলা পরেছে। যাতে মনে হয় চুলটা ছোট করে ছাঁটা। এই সামান্য ব্যাপারেই ওর চেহারায় আকাশ পাতাল তফাত হয়ে গেছে।
রেসের মাঠে যে কোনওদিন যাব সেটা ভাবতে পারিনি। রাস্তার ভিখিরি থেকে রাজা মহারাজা অবধি সবাই যদি কোথাও একই উদ্দেশ্য নিয়ে একই জায়গায় জমায়েত হয় তো সেটা হল রেসের মাঠ। এমন দৃশ্য কলকাতা শহরে আর কোথাও দেখা যায় না, কোথাও দেখার সম্ভাবনাও নেই। একমাত্র রেসের মাঠেই মুড়ি মিছরি এক দর।
ঘোড় দৌড় এখনও শুরু হয়নি, আমরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক জায়গায় একটা বেড়ায় ঘেরা মাঠের মধ্যে যে সব ঘোড়া রেসে দৌডুবে তাদের ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে। ফেলুদা বলল জায়গাটাকে বলে প্যাডক; আরেকটা জায়গা-যেখানে একটা একতলা বাড়ির গায়ে সার সার জানালা, সেখানে বেটিং প্লেস করা হচ্ছে। সকলের মতো আমরাও একটা করে রেসের বই কিনে নিয়েছি। অভিনয় ভাল হবে বলে। লালমোহনবাবু সেটা ভয়ংকর মনোযোগের সঙ্গে পাতা উলটে দেখছেন।
আমরা ছিলাম সব সুদ্ধ আধা ঘণ্টা। প্রথম রেসটা দেখলাম, লোকদের মরিয়া হয়ে ঘোড়ার নাম ধরে চিৎকার করা শুনলাম, তারপর ফেলুদা হঠাৎ এক সময় বলল, যে প্রয়োজনে আসা সেটা যখন মিটে গেছে তখন আর বৃথা মেক-আপের বোঝা বয়ে কী লাভ?
কী প্রয়োজনের কথা বলছে জানি না, জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাব এমন ভরসা নেই, তাই আমরা তিনজন বাইরে বেরিয়ে এসে লালমোহনবাবুর গাড়ি খুঁজে বার করে তাতে চেপে বসলাম।
০৮. দারোগা মণিলাল পোদ্দারের ফোন
রবিবার সকালে দারোগা মণিলাল পোদ্দারের ফোন এল। বললেন, কিছু এগোলেন? ফেলুদা বলল, আগে মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করছি, নইলে এগোতে পারব না। বেশ জটিল কেস বলে মনে হচ্ছে।
মণিলালবাবুর কথা থেকে জানা গেল যে আরেকবার আচার্য বাড়িতে ডাকাত পড়লে উনি আশ্চর্য হবেন না। প্রথমবার তো খুনই করেছে, কোনও জিনিস তো নেয়নি; ওঁর ধারণা যাত্রার যে দলটা খুন করিয়েছে তারা ইন্দ্রনারায়ণবাবুর অন্য নাটক আর গানগুলোও হাতাবার চেষ্টা করবে। বোসপুকুরের কাছেই একটা গলি আছে, রাম পরামানিক লেন, সেটা নাকি নটোরিয়াস গুণ্ডাদের আড্ডা। তা ছাড়া এটাও মণিলালবাবু সন্দেহ করছেন যে আচার্য বাড়ির বেয়ারা সস্তোষের সঙ্গে হয়তো এই গুণ্ডদলের যোগসাজশ আছে।
ফেলুদা প্রশ্ন করল, আপনারা কি বাড়ির পিছনের যদু নস্করের গলিতে পুলিশ পাহারা রাখছেন?
তা রাখা হচ্ছে বইকী, বললেন পোদ্দারমশাই।
তেমন দরকার হলে একবার অন্তত একরাতের জন্য তুলে নেওয়া যেতে পারে কি?
আপনি কি গুণ্ডাদের প্রলোভন দেখাতে চান?
ঠিক তাই।
তা বেশ। আপনার প্রয়োজন হলে বলবেন, আমরা পাহারা সরিয়ে নেব।
পোদ্দার মশাই-এর ফোনটা এসেছিল সাড়ে সাতটার সময়। তার পনেরো মিনিট পরেই ফোন করলেন প্ৰদ্যুন্নবাবু, বললেন আধা ঘণ্টা থেকে নাকি চেষ্টা করছেন। ব্যাপার গুরুতর। গতকাল রাত্রে বারোটার সময় নাকি চোর এসেছিল আচাৰ্যবাড়িতে। ইন্দ্রনারায়ণবাবুর ঘরে ঢুকেছিল নিশ্চয়ই কোনও চাকরের সাহায্যে, কারণ পিছনের গলিতে পুলিশ পাহারা আছে। একটা শব্দ পেয়ে প্ৰদ্যুন্নবাবু নাকি তাঁর কাজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বারান্দায়। তাতে চোরটা পালায়। প্ৰদ্যুম্নবাবু দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে ধাক্কা দিয়ে প্ৰদ্যুম্নবাবুকে মাটিতে ফেলে দেয়। ফলে ভদ্রলোকের হাঁটুতে চাট লেগেছে, উনি নাকি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।
ফোন রাখার পর ফেলুদা বলল, এখন সত্যিই মনে হচ্ছে ওঁর কাগজপত্র সরাবার উদ্দেশ্যেই ইন্দ্রনারায়ণবাবুকে খুন করা হয়েছিল। যে লেখকের নাটক আর গানের এত চাহিদা, সে পাঁচপাঁচ খানা নাটক আর পনের-বিশ খানা গান লিখে রেখে যাবে, আর তার উপরে চোখ পড়বে না। অন্য যাত্ৰা দলের? অবিশ্যি নিয়মমতে এই সব গান আর নাটক ভারত অপেরারই প্ৰাপ্য। তারা যাতে না পায় সেইজন্যেই এগুলো হাতবার এত উদ্যোগ।
আমি বললাম, অন্য যাত্রার দল যদি ইন্দ্রনারায়ণের এই সব গান আর নাটকের কথা জেনে থাকে, তা হলে সে কথা নিশ্চয়ই ইন্দ্রনারায়ণ নিজেই বলেছেন। তার মানে তিনি ভারত অপেরার প্রতি যতটা লয়েল ছিলেন ভাবছিলাম, আসলে হয়তো ততটা ছিলেন না। সত্যিই হয়তো তিনি অন্য দলে যাবার কথা ভাবছিলেন।
কিন্তু তা হলে খুনটা করল কে এবং কেন?
হয়তো বীণাপাণি অপেরাকে ইন্দ্রনারায়ণ কথা দিয়েছিলেন, তাই আরেকটা দল সে পথ বন্ধ করেছে।
ফেলুদা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিল। সত্যি, এখনও পর্যন্ত রহস্যের কোনওই কিনারা হল না।
ফেলুদা তার বিখ্যাত সবুজ খাতা খুলে কী যেন লিখতে শুরু করল। আজ সকাল থেকেই তাকে ভীষণ সিরিয়াস দেখছি। কী যেন একটা নতুন চিন্তা তার মাথায় এসেছে সেটা বুঝতে পারছি না।