গোলমেলে ব্যাপার, ফেলুদা মন্তব্য করল চৌরঙ্গিতে একটা রেস্টোরেন্টে বসে কফি খেতে খেতে।
বীণাপাণি অপেরাই যে গুণ্ডা লাগিয়ে খুন করেছে সেটা এখন আর মনে হচ্ছে না—তাই না? বললেন লালমোহনবাবু।
তা হচ্ছে না, বলল ফেলুদা, তবে প্রশ্ন হচ্ছে শত্রুবিহীন এই ব্যক্তিটির উপর কার এত আক্রোশ ছিল? ভাড়াটে গুণ্ডাই যদি মেরে থাকে তা হলে ফেলুমিত্তিরের বিশেষ কিছু করবার নেই। সেখানে পোদারমশাই টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবেন।
কিন্তু অশ্বিনীবাবুর কথা শুনে—
অশ্বিনীবাবু যে সত্যি কথা বলছেন সেটাই বা মেনে নিই। কী করে? সেদিন ওঁর কথায় যে ইন্দ্রনারায়ণ সরাসরি না করে দেননি। সেটাই বা কে বলতে পারে? সাক্ষী কই?
আচ্ছা, বাড়ির লোক যদি খুন করে থাকে?
সেটার সম্ভাবনা একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। কীর্তিনারায়ণ তাঁর ছোট ছেলেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। তিনি যদি তাঁর উইলে ইন্দ্রনারায়ণকে বেশি টাকা দিয়ে থাকেন, তাতে বড় ভাইদের কি মনে হতে পারে না ছাটভাইকে হটিয়ে তাদের শেয়ার কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া?
এটা আপনি মোক্ষম বলেছেন, বললেন লালমোহনবাবু।
কিন্তু ব্যাপার কী জানেন? খুন জিনিসটা করা অত্যন্ত কঠিন। প্রচণ্ড তাগিদ না থাকলে সাধারণ মানুষের পক্ষে খুনের সাহস সঞ্চয় করা সম্ভব নয়। আগে অন্য ভাই দুটোকে একটু বাজিয়ে নিই, তারপর তেমন বুঝলে ওটা নিয়ে ভাবা যাবে।
ফেলুদার কপালে ভ্রূকুটি তাও যাচ্ছে না দেখে জিজ্ঞেস করলাম। সে কী ভাবছে। ফেলুদা বলল, সেকেন্ড ব্রাদার হরিনারায়ণের কথা।
কেন?
লোকটা আবার ওয়েস্টার্ন মিউজিকের ভক্ত—ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক। এই নিয়ে যে দুটো প্রশ্ন করব তারও জো নেই। কারণ ফেলুমিত্তির ও ব্যাপারে একেবারেই কাঁচা।
লালমোহনবাবু বললেন, আমার কাছে একটা পাশ্চাত্য সংগীতের এনসাইক্লোপিডিয়া আছে—এক ভলুম, সাড়ে সাতশো পাতা। তাতে আপনি যা জানতে চান সব পাবেন।
আপনি ও বই নিয়ে কী করছেন?
ওটা একটা সেটের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল—তাতে হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি, মেডিসিন, সায়েন্স, অ্যানিম্যালস—সবই আছে। আমি নিজে উলটে পালটে দেখেছি মিউজিকের বইটা হেডন, মোজার্ট, বিথোভেন সব বড় বড় সুরকারদের জীবনী রয়েছে।
আমি এসব সুরকারদের রচনা শুনিনি বটে, কিন্তু এদের নামের উচ্চারণগুলো অন্তত আমার জানা আছে, কিন্তু আপনার নেই।
কী রকম?
হাইড্রন, মোৎসার্ট, বেটাফেন-এই হল আসল উচ্চারণ।
হাইড্রন, মোৎসার্ট, বেটাফেন-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আর ভুল হবে না।
এখনই দিতে পারেন বইটা?
অ্যালবত! আপনার জন্য এনি টাইম।
আমরা রেস্টোরাল্ট থেকে গড়পার গিয়ে লালমোহনবাবুর বইটা তুলে নিয়ে ভদ্রলোককে বাড়িতে রেখে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
বাকি দিনটা ফেলুদার সঙ্গে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি, কারণ সে ঘর বন্ধ করে এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ওয়েস্টার্ন মিউজিক পড়ল।
০৬. হরিনারায়ণবাবুর মেয়ে লীনা
শনিবার সকাল দশটায় বোসপুকুর গিয়ে প্রথমেই যার সঙ্গে কথা হল, সে হল হরিনারায়ণবাবুর মেয়ে লীনা। লীনার আজ ইস্কুল ছুটি, সে ক’দিন থেকেই শুনেছে বাড়িতে ডিটেকটিভ এসেছে। তাই উদগ্ৰীব হয়ে আছে। ফেলুদার ভক্ত হওয়াতে তার সঙ্গে কথা বলতে আরও সুবিধা হল।
তোমার ছোটকাকা তোমাকে খুব ভালবাসতেন, তাই না? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
শুধু ভালবাসতেন না, বলল লীনা, আমরা দুজনে বন্ধু ছিলাম। কাকার সব লেখা আগে আমাকে পড়ে শোনাতেন। আমার যদি কোনও জায়গা গোলমাল লাগত। তা হলে কাকা সেটা বদলে দিতেন।
আর গান?
আমাকে প্রথম শোনাতেন।
তুমি নিজে গান ভালবাস?
আমি পিয়ানো শিখছি।
তার মানে তো বিলিতি বাজনা।
হ্যাঁ, কিন্তু আমার রবীন্দ্রসংগীতও ভাল লাগে, আর কাকার গানও ভাল লাগত। আমি নিজেও গান করি একটু একটু।
তোমার কাকা কোনওদিন ভারত অপেরা ছেড়ে দেবার কথা বলেছিলেন তোমাকে?
বীণাপাণি অপেরা কাকাকে অনেক টাকা দিতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু আমার মনে হয় না। কাকা কোনওদিন ভারত অপেরা ছাড়তেন। আমায় বলতেন, আমার শেকড় ভারত অপেরায়; শেকড় তুলে অন্য জায়গায় গেলে কি আর আমি বাঁচব?
কাকা একটা নতুন নাটক লিখছিলেন সেটা তুমি জান?
একটা কেন; সম্রাট অশোক তো শেষ হয়নি; তা ছাড়া কাকার চারটে নাটক লেখা ছিল। এছাড়া ওঁর প্রায় পনেরো-কুড়িটা খুব ভাল ভাল গান লেখা ছিল যেগুলো এখনও যাত্রায় ব্যবহার হয়নি। আর নাটকের খসড়া যেগুলো ছিল-সেও প্রায় আট-দশটা হবে।–সেগুলো তো খসড়াই রয়ে গেল!
লীনার সঙ্গে কথা বললাম। প্ৰদ্যুম্নবাবুর ঘরে। খুব সাদাসিধে। ঘর, লাইব্রেরির ঠিক পাশেই। ভদ্রলোক বললেন যে ওঁর রিসার্চের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে, এর পর কাগজপত্র সব নিয়ে উনি বইটা লেখার জন্য শ্ৰীীরামপুরে ওঁর বাড়িতে চলে যাবেন! ওঁর আন্দাজ এক বছর লাগবে। বইটা লিখতে।
অবিশ্যি রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে এখানে থাকতেই হবে সেটা বোধ হয় বুঝতেই পারছেন।
সে কথা পুলিশ আগেই বলে দিয়েছে।
আপনি চলে গেলে কীর্তিনারায়ণবাবুর সেক্রেটারির কী হবে?
সে আমি অন্য একটি ছেলেকে বদলি দিয়ে যাব। জীবনী একবার লিখতে আরম্ভ করলে অন্য কোনও দিকে মন দিতে পারব না।
ফেলুদা ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছিল, আর ঘরের দরজা দিয়ে বাইরের কী অংশ দেখা যায় সেটাও দেখছিল। দেখলাম প্ৰদ্যুম্নবাবুর শোবার ঘর থেকে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাজের ঘরের দরজাটা দেখা যায়, কিন্তু লাইব্রেরি থেকে দুটোর একটা ঘরও দেখা যায় না। ঘরের পিছনের জানালা দিয়ে বাইরে গলি দেখা যায়—যদু নস্কর লেন। বোসপুকুর রোডটা হল বাড়ির সামনে, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকের বাগানের পরে।