তারপর কয়েক মুহূর্ত পরে প্রায় আপন মনেই বললেন, আমি কি ভুল করলাম? আশা করি ভুল করেছি। কারণ জিনিসটা সত্যি হলে, আমার পক্ষে আরও দ্বিগুণ বেদনাদায়ক হবে।
আপনি কীসের কথা বলছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
সে আপনি জানতে চাইবেন না, কারণ আপনাকে বলতে পারব না।
আপনি কিছু টের পাননি?
টের পেয়েছি, কিন্তু পেয়েও কিছু করতে পারিনি।
আপনার কথায় একটা রহস্যের সুর রয়েছে, সেটা আপনি উদঘাটন করবেন কি? করলে, আমাদের অনেক সুবিধে হত।
সে অনুরোধ আমায় করবেন না, মিঃ মিত্তির। আপনি যদি এবার আমাকে রেহাই দেন, আমি বাধিত হব।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই-।
আমরা তিনজন উঠে পড়লাম। তবে আমি নিজের স্বার্থে তদন্ত করতে চাই আপনার বাড়ির এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে। তাতে আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।
মোটেই না, অপরাধী যেই হোক না, তাকে ধরা কর্তব্য।
০৬. তস্করের শিরোমণি
বাড়ি এসে লালমোহনবাবু বললেন, সোমেশ্বরবাবুর কথাগুলো ভারী রহস্যজনক মনে হচ্ছিল, তাই না?
ঠিকই বলেছেন। বলল ফেলুদা।
আমার মনে হয়, ভদ্রলোক বেশ কিছু কথা লুকিয়ে গেলেন।
আমারও সেই রকমই মনে হয়েছে।
আপনি নিজে কী বুঝেছেন?
একেবারে অন্ধকারে আছি, তা নয়। তবে ম্যাজিকের জগৎ নিয়ে একটু অনুসন্ধান চালাতে হবে। তা ছাড়া অকশন-হাউসও একটা ব্যাপার আছে। আমি বরং একটু ঘুরে আসি। আপনারা দুজনে আড্ডা মারুন।
আমি একটা কথা এই বেলা ফেলুদাকে না বলে পারলাম না। আচ্ছ ফেলুদা, নিখিলবাবুর কথা শুনে কি তোমার কিছু মনে হয়েছিল?
সেটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেন নয়, সেটা অবিশ্যি তোকে ভেবে বার করতে হবে। ফেলুদা বেরিয়ে গেল।
লালমোহনবাবু বললেন, আমার কিন্তু এই আর্টিস্ট ভদ্রলোককে মোটেই ভাল লাগছে না। অবিশ্যি চাপ-দাড়ির বিরুদ্ধে আমার একটু প্রেজুডিস আছে এমনিতেই।
সূর্যকুমার ভদ্রলোকটিকে আপনার ভাল লাগছে?
ও-ও কেমন যেন পিকিউলিয়ার। তবে প্রথম দিন এসেই ও সিন্দুক খুলবে বলে মনে হয় না। ওই বাড়ির সঙ্গে তো ওর বিশেষ পরিচয় নেই। কোনটা কার ঘর, কোথায় সিন্দুক আছে, কোথায় সিন্দুকের চাবি আছে~—এসব জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে এ চার খুনি-চার। ওকে যখন বেয়ারা দেখে ফেলল, তখন তো ও ওকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিতে পারত। পালানো নিয়ে তো কথা, আর বেয়ারার বয়সও ষাটের কাছাকাছি। বোঝা যাচ্ছে যে চার ছুরি হাতে নিয়েই কুকীর্তিটা করতে বেরিয়েছিল।
এটা আপনি ঠিকই বলেছেন।
সোমেশ্বরবাবুও কী বলতে গিয়ে বললেন না, সেটা জানতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয়। ওখানে একটা ইম্পট্যান্ট কু লুকিয়ে আছে।
ঠিক এই সময় একটা ফোন এল। তুলে হ্যালো বলতে ওদিক থেকে প্রশ্ন এল, মিঃ মিত্তির আছেন?
ইনস্পেক্টর ঘোষ। বললাম, ফেলুদা একটু বেরিয়েছে।
ভদ্রলোক বললেন, ওঁকে বলে দেবেন। যে কালপ্রিট ধরা পড়েছে। গোপচাঁদ বলে এক চোর—রিসেন্টলি জেল থেকে বেরিয়েছে। অবিশ্যি লোকটা স্বীকার করেনি এখনও, কিন্তু সেদিন রাত্রে ও বেরিয়েছিল, সে খবর আমরা পেয়েছি। এটা আপনি জানিয়ে দেবেন। আর স্বীকারোক্তি পেলে, আবার আপনাকে টেলিফোন করব। আপনার দাদাকে নিশ্চিন্ত হতে বলে দেবেন।
আমি ফোন রেখে দিলাম। মনটা কেমন জানি দমে গেল। এ তো ঠিক জমল না।
ঘণ্টা দেড়েক পরে ফেলুদা আসাতে, আমি প্রথমেই ওকে ইনস্পেক্টরের কথাটা বললাম। ফেলুদা যেন গা-ই করল না। বলল, সূর্যকুমারের ম্যাজিক খুব ভাল চলছে না, নিখিলবাবুর দোকানের অবস্থাও ভাল নয়। আর আমাদের আর্টিস্ট রণেন তরফদার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টের ছাত্র ছিলেন না। প্যারিসে আঁকা শিখেছিলেন। কিনা, সেটা অবিশ্যি জানতে পারিনি।
তা হলে এখন কী করণীয়? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
আমার দিক থেকে মোটামুটি কাজ শেষ। এখন রইল। শুধু রহস্য উদঘাটন। দাঁড়ান, আগে ইনস্পেক্টর ঘোষকে একটা ফোন করি।
ফেলুদা ফোনে প্রথমেই বলল, আপনার সমাধান যে মানতে পারছি না, মিঃ ঘোষ।
ঘোষের উত্তরের পর ফেলুদা বলল, আমার ধারণা খুনি ওই বাড়িরই লোক। আপনি এক কাজ করুন। আমার সমাধান রেডি। আমি আজ বিকেলে সেটা ঘোষণা করতে চাই সোমেশ্বরবাবুর ওখানে। আপনিও আসুন। আমার কথা শুনে আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলবেন। আমার এ অনুরোধটা আপনাকে রাখতেই হবে। তা ছাড়া আপনাকে খুনিকে গ্রেপ্তার করার জন্য তৈরি হয়ে আসতে হবে।… থ্যাঙ্ক ইউ।
ফেলুদা ফোন রেখে বলল, ভদ্রলোক রাজি। গোপচাঁদ-ছাঁ! এইজন্যই মাঝে মাঝে পুলিশের উপর থেকে ভক্তি চলে যায়।
এরপর ফেলুদা সোমেশ্বরবাবুকে একটা ফোন করে, বিকেলে ওঁর ওখানে যাবার কথাটা বলে দিল। সেই সঙ্গে এ-ও বলে দিল যে সবাই যেন উপস্থিত থাকে।
বিকেল পাঁচটায় আমরা সোমেশ্বরবাবুর নীচের বৈঠকখানায় জমায়েত হলাম। ইনস্পেক্টর ঘোষ আর দুজন কনস্টেবল এসে গিয়েছিল আগেই।
সকলে যো-যার জায়গায় বসলে পর, ফেলুদা শুরু করল।
প্রথমেই আমাদের যে প্রশ্নটার সামনে পড়তে হচ্ছে, সেটা হল চোর বাইরের লোক না। ভেতরের লোক। এখানে প্রথম যেদিন চোর আসে, তার পরদিন আমি এসেছিলাম। বাড়ির চারদিকে ঘুরে মনে হয়েছিল—এখানে বাইরে থেকে চোর ঢোকা খুব মুশকিল। বারান্দার থাম বেয়ে উঠলেও, জিনিসপত্তর চুরি করে থাম বেয়ে নামার সুবিধে নেই। কাজেই আমার বাড়ির লোকের কথাই বেশি করে মনে হয়েছিল, এবং চোরের দৃষ্টি যে কীসের দিকে, সে সম্বন্ধেও আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।