সবচেয়ে সুবিধে বারান্দা দিয়ে! আসলে আমার দারোয়ান একটু কর্তব্যে টিলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
বাড়ির বারান্দা যে দিকে, সে দিকেই একটা বাগান রয়েছে। তবে সেটাকে খুব যত্ন করা হয় বলে মনে হল না। বাড়ির চারিদিকে বেশ উঁচু কম্পাউন্ড ওয়াল, সেটা টপকে পেরোনো সহজ নয়। দেয়ালের দুধারে গাছপালাও বিশেষ নেই।
ফেলুদা মিনিট পনেরো ঘোরাঘুরি করে বলল, চোর সম্বন্ধে ঠিক শিওর হওয়া গেল না। বাড়ির চোর না বাইরের চোর, সে-বিষয়ে সংশয় রয়ে গেল।
০৩. সোমেশ্বরবাবু টেলিফোনে জানালেন
পরদিন সোমেশ্বরবাবু টেলিফোনে জানালেন যে সূৰ্যকুমারের সঙ্গে ওঁর কথা হয়ে গেছে। উনি খাতাটা বিক্রি করবেন না বলে দিয়েছেন।
ভাল কথা। বললেন লালমোহনবাবু, আমার জাদুকর নিয়ে একটা ভাল প্লট মাথায় এসেছে। ভাবছিলাম, সূৰ্যকুমারের সঙ্গে কী করে একটু কথা বলা যায়।
ওকে হোটেলে ফোন করুন। বলল ফেলুদা, কোন হোটেলে আছে সে তো যারা আমাদের টিকিট দিয়েছিল, তারাই বলে দেবে।
তা বটে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে লালমোহনবাবু সূৰ্যকুমারের সঙ্গে কথা বলে, তার সঙ্গে একটা অ্যাপায়েন্টমেন্ট করে নিলেন আমাদের বাড়িতেই। ভদ্রলোক আগামীকাল সকালে সাড়ে নটায় আসবেন।
আপনি কিন্তু আমাকে দেখলেই চিনবেন। বললেন লালমোহনবাবু, আমি সেদিন আপনার দ্বারা হিপনোটাইজড হয়েছিলাম।
পরদিন একটা মারুতি গাড়িতে ঠিক সাড়ে নটার সময় সূৰ্যকুমার এসে হাজির। লালমোহনবাবু অবিশ্যি মিনিট কুড়ি আগেই চলে এসেছিলেন। সূৰ্যকুমার ফেলুদাকে দেখে কেমন হক্চকিয়ে গেলেন। বললেন, আপনার পরিচয়টা পেতে পারি কি? আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
ফেলুদা বলল, আমার নাম প্রদোষ মিত্র। হয়তো খবরের কাগজে ছবি দেখে থাকবেন।
প্রদোষ মিত্ৰ মানে গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্ৰ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমার পরম সৌভাগ্য।
সৌভাগ্য তো আমারও। আপনার মতো একজন দক্ষ ম্যাজিশিয়ানের পায়ের ধুলো পড়ল আমাদের বাড়িতে, সেও কি কম সৌভাগ্য?
চায়ের পর লালমোহনবাবু প্রশ্ন আরম্ভ করলেন।
আপনি কদ্দিন ম্যাজিক দেখাচ্ছেন?
তা বারো বছর হল।
কারুর কাছে শিখেছেন কি?
আমি নক্ষত্র সেন ঐন্দ্ৰজালিকের সহকারী ছিলাম পাঁচ বছর। তাঁর বয়স হয়েছিল-স্টেজেই ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে ষ্ট্রোক হয়ে মারা যান। তাঁর সব ম্যাজিকের সরঞ্জাম আমার হাতে পড়ে। আমি তাই দিয়েই শুরু করি।
আপনাকে কি সারা ভারতবর্ষ ঘুরে খেলা দেখাতে হয়?
হ্যাঁ। শুধু ভারতবর্ষ কেন, আমি জাপান আর হংকংও গিয়েছি।
বটে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আগামী বছর সিঙ্গাপুর থেকে নেমন্তগ্ন আছে।
আপনার ফ্যামিলি নেই?
না। আমি ব্যাচেলার।
এখনও ম্যাজিক অভ্যাস করতে হয় আপনাকে, না। আর দরকার হয় না?
এখনও সকালে দুঘণ্টা হাত-সাফাই প্র্যাক্টিস করি। ওটা থামালে চলে না।
এবার ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল।
আপনার সঙ্গে সোমেশ্বর বর্মনের বোধহয় আলাপ হয়েছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি তো ভারতীয় জাদুবিদ্যার পাণ্ডুলিপিটা কিনতে চেয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কেন?
আমি ভেবেছিলাম আমার বিলিটি ম্যাজিকের মধ্যে কয়েকটি দিশি আইটেম ঢোকাতে পারলে অ্যাট্রাকটিভ হবে। কিন্তু ভদ্রলোক বই বিক্রি করলেন না। আমি বিশ হাজার অফার করেছিলাম। তবে বিক্রি না করলেও, ওঁর সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কারণ আমি ওঁকে সত্যিই শ্রদ্ধা করি। উনি আমার শো শেষ হলে পর ওঁর বাড়িতে গিয়ে আমাকে কয়েকদিন থাকতে বলেছেন।
আপনার শো শেষ হচ্ছে কবে?
এই রবিবার।
এর পর কোথায় যাওয়া?
দিন সাতেক বিশ্রামের পর পাটনা যাব।
লালমোহনবাবুর আরও দু-একটা প্রশ্ন ছিল, তারপরেই ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। আমারও ভদ্রলোককে খারাপ লাগল না।
ফেলুদা বলল, বিদেশি জামাকাপড় জুতো পরেছে। বোধহয় জাপান কি হংকং-এ কেনা। এমনিতে বেশ শৌখিন লোক, যেমন ম্যাজিশিয়ানরা সাধারণত হয়।
সোমেশ্বরবাবুদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছেন বলুন? বললেন লালমোহনবাবু, নইলে আর বাড়িতে এসে থাকতে বলে!
০৪. একেবারে বজ্রপাত
এ সপ্তাহটায় আর কোনও ঘটনা ঘটল না। তারপর যেটা হল, সেটা একেবারে বজ্রপাত! মঙ্গলবার দিন সোমেশ্বরবাবু ফোন করে জানালেন যে তাঁর বাড়িতে খুন হয়েছে তাঁর বহুদিনের বেয়ারা অবিনাশ, আর সেইসঙ্গে সিন্দুক থেকে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ হাওয়া! একসঙ্গে ডবল ট্রাজেডি।
ফেলুদা তৎক্ষণাৎ লালমোহনবাবুকে ফোন করে বলে দিল সোমেশ্বরবাবুর বাড়িতে আসতে, আর আমরা ট্যাক্সি করে চলে গেলাম।
গিয়ে দেখি, পুলিশকেও খবর দেওয়া হয়েছে। ইনস্পেক্টর ঘোষ ফেলুদার চেনা, দেখে বললেন, স্রেফ ডাকাতির কেস। খুন করার মতলব ছিল না; সামনে বাধা পেয়ে খুন করেছে। আসল উদ্দেশ্য ছিল সিন্দুক থেকে ওই কৃষ্ণটা নেওয়া। এ বাইরের লোকের কাজ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই সেদিন একটা ডাকাতির কেস হয়ে গেছে।
ওই কৃষ্ণের কথা কিন্তু এ বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানত না।
তা হলে এ বাড়ির ভেতর থেকেই ব্যাপারটা হয়েছে। সোমেশ্বরবাবুর ছেলে আছেন, সেক্রেটারি আছেন, বন্ধু আছেন, আর্টিস্ট রণেন তরফদার আছেন, সূর্যকুমার বলে সেই ম্যাজিশিয়ান কাল থেকে এখানে রয়েছেন; এর মধ্যেই কেউ গিলটি। আর যদি তাই হয়, তা হলে তো আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে।
খুনটা কখন হয়েছে?
রাত একটা থেকে তিনটের মধ্যে।
বেয়ারা কি চোরকে বাধা দিতে গোসল?