পাম এভিনিউ পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গেই রুনার গলায় উচ্ছসিত চিৎকার শোনা গেল, জেঠু এসে গেছে!
অম্বরবাবু ফিরেছেন আমরা আসার মিনিট দশেক আগে। আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকতেই ভদ্রলোক সোফা ছেড়ে উঠে হাত বাড়িয়ে ফেলুদার হাত দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে দিলেন। ভাই ভাইয়ের বউ, ভাইঝি, সমরেশবাবু, বিলাসবাবু, সকলেই ঘরে রয়েছেন।
কোথায় আটক করে রেখেছিল আপনাকে? একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
ওঃ–সে। আর বলবেন না—
ফেলুদা হাত তুলে বাধা দিল ভদ্রলোককে।
উনি তো বলবেনই না, আর আপনিও বলবেন না, মিঃ সেন। কারণ বললেই একরাশ কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। মিথ্যে শব্দটা ব্যবহার করলাম না, কারণ সেটা ভাল শোনায় না।
হুররে হুররে হুররে! চেঁচিয়ে উঠল। রুনা। ফেলুদা ধরে ফেলেছে, ফেলুদা ধরে ফেলেছে!
এবার ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে নিয়ে বলল, আপনারা যে একটা বিরাট ফন্দি ঐটেছিলেন সেটা ধরে ফেলেছি, কিন্তু সেটার কারণটা এখনও ঠিক ধরতে পারছি না।
কারণ বলছি মিঃ মিত্তির, হেসে বললেন অম্বর সেন। কারণ আমার ওই খুদে ভাইঝিটি। সে আপনাকে বলতে গেলে একরকম পুজোই করে। তার ধারণা। আপনি ভুলভ্রাস্তির উর্ধে। তাই ওকে আমি সেদিন বললাম যে, তোর ফেলুদাকে আমি জব্দ করতে পারি। ব্যস-ওই একটি উক্তি থেকেই সমস্ত ফন্দিটির উৎপত্তি। এতে আমাদের সকলেরই ভূমিকা আছে।
অর্থাৎ এও আপনাদের একটা ফ্যামিলি নাটক?
ঠিক তাই। সবাইকে সব কিছু আমিই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলাম। আপনি কী জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবে, সব লিখে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলাম—এমনকী ড্রাইভার ও চাকরকে পর্যন্ত। প্রধান নারীচরিত্র অবশ্য বউমা, যাঁকে দিয়ে মনগড়া অ্যাকসিডেন্টের কথাটা বালানো হয়েছিল। আমি নিজে ভাবিনি যে, আপনি ব্যাপারটা ধরে ফেলবেনী-ইন ফ্যাক্ট, এই নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে একশো টাকা বাজিও ধরেছিলাম। এ ব্যাপারে রুনার উৎকণ্ঠই ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ তার হিরো যদি ফেল করত, তা হলে তার দুঃখের সীমা থাকত না। এই ঝুকিটা অবশ্য আমাকে নিতেই হয়েছিল, কিন্তু এখন সে নিশ্চিন্তু। এবার বলুন তো আপনার সিসটেমটা কী। কীসে আপনার প্রথম সন্দেহ হল মিঃ মিত্তির?
ফেলুদা বলল, প্রথমত এবং প্রধানত, দুটো ভুকু, দুটোই আপনার কাজের ঘরে পাওয়া। এক হল হিমালয়ান অপটিক্যালসের ক্যাশ মেমো। আমি সেখানে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, আপনি দিন সাতেক আগে একটি সোনালি ফ্রেমের নতুন চশমা করিয়েছেন। অথচ আপনার বাড়িতে সেটা সম্বন্ধে কেউ জানে না, বা কেউ সেটা আপনাকে পরতে দেখেনি। প্রশ্ন হল, এই চশমার দরকার পড়ছে কেন। এবং ঠিক এই সময় দরকার কেন।
দুই হল—আপনার ডেট ক্যালেন্ডারে তিন দিনের পুরনো তারিখ। আপনার চাকর যখন তারিখ বদল করে না, তখন সেটা নিশ্চয় আপনিই করেন। তা হলে বদল হয়নি কেন?
তখনই মনে হল যে, আপনাকে যদি কিডন্যাপড় হবার ভান করে গা ঢাকা দিতে হয়, তা হলে হয়তো একটা ড়েরা স্থির করে দুদিন আগে গিয়েই সেখানে থাকা অভ্যাস করতে হবে। নতুন জায়গা ধাতস্থ হতে সময় লাগে বইকী!! আর তাই যদি হয়, তা হলে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য আপনাকে হয়তো একটি ছদ্মবেশ ও একটি নতুন নাম নিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে একটি নতুন চশমা নেওয়াও মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
ধরে ফেলেছে, ফেলুদা সব ধরে ফেলেছে। আবার চেঁচিয়ে উঠল রুনা।
এর মধ্যে লালমোহনবাবু যে হঠাৎ কেন খাঁচায়-বন্ধ সিংহের মতো পায়চারি করতে আরম্ভ করেছেন তা বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক যাতে কোনও বাড়াবাড়ি না করে ফেলেন। তাই ওঁকে সামলাতে যাব, এমন সময় উনি হঠাৎ দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন–
ইউরেকা!
চিনেছেন ভদ্রলোককে? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
চিনব না? মৃত্যুঞ্জয় সোম!
অম্বরবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন।
আপনার সঙ্গে সেদিন পর্কে দেখা হওয়াটা সম্পূর্ণ অ্যাকসিডেন্ট, মশাই। আসলে গড়পারেই আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ছিলাম সাতদিন। আপনি যখন এগিয়ে এসে জটায়ু-টটায়ু বলে নিজের পরিচয় দিলেন, তখন ভাবলাম— বা রে, এ তো বেশ মজা! যাকে জব্দ করতে যাচ্ছি তারই সাকরেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! তা হলে এঁকে নিয়ে একটু রগড় করতে পারলে কেমন হয়? তারপর অবিশ্যি মিত্তির মশাইয়ের বাড়িতেও আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার আসল চেহারায়, কিন্তু আপনি চিনতে পারেননি।
কিন্তু তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? বলল ফেলুদা, নাটকের তো এখানেই শেষ নয়, অম্বরবাবু। এখনও তো ড্রপসিন ফেল চলবে না।
ঘরের আবহাওয়া মুহূর্তে বদলে গেল, কারণ ফেলুদা কথাটা বলেছে গম্ভীর থমথমে ভাবে।
হোয়্যার ইজ দ্য মানি? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
অম্বর সেন ফেলুদার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, মিঃ মিত্তির, আপনি আমাকেও কিন্তু একজন শখের গায়েন্দা বলতে পারেন। আমি যদি বলি যে, টাকাটা আপনিই নিয়ে আমাদের সঙ্গে একটু রগড় করছেন, তা হলে কি খুব ভুল বলা হবে? অপরাধী যখন নেই, কিডন্যাপার নেই, তখন টাকাটা সরে কোথায় যাবে মিঃ মিত্তির?
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, মিঃ সেন অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আপনার শখের গোয়েন্দাগিরি এক্ষেত্রে খাটল না। প্রিনসেপঘাটের কাছে আজ। সন্ধ্যায় আমি ছাড়াও আরেকজন ছদ্মবেশী ছিলেন।
বলেন কী! বললেন অম্বর সেন, আপনি তাকে দেখেছেন?
দেখেছি, কিন্তু চিনিনি।