বিকেলে সাড়ে চারটের সময় লালমোহনবাবু এলে পর ফেলুদার প্রথম কথা হল, মশাই, এমন অভিনব কেস আর আমি কোনওদিন পাইনি।
অবিশ্যি আমাকে জিজ্ঞেস করলে পরে আমি এখনও বলতে পারব না। এর বিশেষত্বটা কোথায়।
তা হলে আমরা কী করছি? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
শুনে নিন। মন দিয়ে, বলল ফেলুদা।তুইও শোন, তোপ্সে। সাড়ে পাঁচটার সময় আপনার গাড়ি নিয়ে আপনি আর তোপ্সে চলে যাচ্ছেন গে রেস্টোরান্টে। সেখানে আপনাদের অভিরুচি অনুযায়ী পানাহার সেরে ঠিক সোয়া ছাঁটায় রেস্টোরন্ট থেকে বেরিয়ে সটান চলে যাবেন দক্ষিণে প্রিনসেপঘাট লক্ষ্য করে। গাড়ি রেখে যাবেন রেস্টোরান্টের সামনে। থামওয়ালা ঘাটটার কাছে পৌঁছনোর কিছু আগেই দেখবেন ডানদিকে একটা গম্বুজওয়ালা বসার ঘর রয়েছে। দুজনে সেখানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে পড়বেন। ভাবটা এমন হওয়া চাই যেন সান্ধ্যভ্রমণ আর বায়ুসেবন ছাড়া আপনাদের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। ঘাটের দিকে আড়দৃষ্টি রাখবেন, তবে যেন মনে না। হয় যে, ওটাই আপনাদের লক্ষ্য। তারপর সাড়ে ছাঁটার দশ মিনিট পর ওখান থেকে উঠে পড়ে নিজের গাড়িতে ফিরে আসবেন। আমিও সেখানেই আপনাদের মিট করব।
০৪. ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চলল
ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চলল, কিন্তু এখনও দিব্যি ঠাণ্ডা। তবে শীতকালের মতো দিন। আর অত ছোট নেই, ছটা পর্যন্ত বেশ আলো থাকে। আমি আর লালমোহনবাবু কফি আর মুরগির কাটলেট খেয়ে ঠিক সোয়া ছাঁটায় রেস্টোরান্ট থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম প্রিনসেপঘাটের দিকে।
পথে লালমোহনবাবু মাঝে-মাঝে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আঃ উঃ শব্দ করে সান্ধ্যভ্রমণের অভিনয় করছেন, সেটা যে খুব কনভিনসিং হচ্ছে তা নয়। কিন্তু ক্ৰমেই আশপাশের লোকজন এত কমে আসছে, ফুচকাওয়ালা আর ভেলপুরিওয়ালার দল এত পিছিয়ে পড়ছে যে, এখন উনি যা খুশি করলেও আপত্তির কিছু নেই।
দশ মিনিট লাগল আমাদের গম্বুজওয়ালা বসার জায়গাটায় পৌঁছতে। বেঞ্চ দখল করার পর এদিক ওদিক চেয়ে লালমোহনবাবু চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন, তোমার দাদাকে দেখতে পাচ্ছ কি, তপেশ?
দাদা কেন, কোনও মানুষকেই দেখতে পাচ্ছি না ঘাটের নীকের মাঝিদের ছাড়া। কোনখানে লুকিয়ে রয়েছে ফেলুদা কে জানে। ঘাটের দেড়শো বছরের পুরনো থামগুলো মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে ফাঁকগুলো ক্রমেই অন্ধকারে হয়ে আসছে। ওখানে গিয়ে কেউ টাকার ব্যাগ রাখলে, বা সে ব্যাগ নিতে এলে, কেউ দেখতেও পাবে না।
ওই যে! লালমোহনবাবু আমার হাত খামচে ধরেছেন।
হ্যাঁ—ঠিকই দেখেছেন ভদ্রলোক।
একজন সাদা প্যান্ট আর কালো কোট পরা লোক হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিনসেপঘাটের দিকে। অম্বরবাবুদের ড্রাইভার। বিলাসবাবু।
বিলাসবাবু এবার থামগুলোর ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
মিনিটখানেক পরেই তাঁকে আবার দেখা গেল। এবার হাত খালি। বড়রাস্তায় পড়ে ডাইনে মোড় ঘুরে গাছের আড়াল হয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
সাড়ে ছটা বেজে গেছে। আলো আরও পড়ে এসেছে। এখন সামনের সারির থামগুলো ছাড়া আর কোনওটাই দেখা যাচ্ছে না। একবার মনে হল অন্ধকারের মধ্যে কে যেন নড়াল; কিন্তু সেটা চোখের ভুল হতে পারে।
এবার দেখলাম সেনদের গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে রেস্টোরান্টের দিকে চলে গেল। তারপর তিনজন জিনস-পরা ছেলে, আর তাদের পিছনে ঢোলা প্যান্টপরা হাতে লাঠিওয়ালা এক বৃদ্ধ ফিরিঙ্গিও সেই দিকেই চলে গেল।
আমরাও উঠে পড়লাম।
আবার ঠিক দশ মিনিটই লাগল আমাদের গাড়িতে পৌঁছাতে।
কিন্তু ফেলুদা কই?
এবার গাড়ির ভিতরে চোখ গেল।
নস্যিরঙের আলোয়ান জড়ানা এবং লুঙ্গি পরা এক বুড়ো বসে আছে ড্রাইভার হরিপদবাবুর পাশে। থুতনিতে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, কিন্তু গোঁফ নেই।
স্যালাম কর্তা! লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বলল লোকটা।
এ আর বলতে হবে না। ওই মুসলমান মাঝি ফেলুদা ছাড়া আর কেউ না। এদিকে অম্বুজবাবুও এসে পড়েছেন রাস্তার ওদিক থেকে। তাঁর কাছে ফেলুদার নিজের পরিচয় দিতেই হল। নীকো থেকে ঘাটটা সবচেয়ে ভাল দেখা যায়, তাই ওখানেই ওত পাতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
কিন্তু কী হল সেইটে বলুন, মিঃ মিত্তির।
ফেলুদা গম্ভীর।
ভেরি সরি, মিঃ সেন।
মানে?
আমি ঘাটে ওঠার আগেই সে লোক টাকা নিয়ে হাওয়া।
বলেন কী! টাকা নেই? লোকটাকেও ধরা গেল না?
বলছি তো—আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
অম্বুজবাবু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন ফেলুদার দিকে। কথাটা যেন ভদ্রলোকের বিশ্বাসই হচ্ছে না। সত্যি বলতে কী, আমারও কেমন যেন মাথা বিমঝিম করছিল। ফেলুদাকে এভাবে হার মানতে এর আগে দেখিনি কখনও।
আপনাদের পুলিশের সাহায্যই নিতে হবে, মিঃ সেন, বলল ফেলুদা। আপনি বাড়ি চলে যান। এবার তো অম্বরবাবুর ফিরে আসা উচিত। আমরা একবার বাড়িতে টু মেরে আপনার ওখানেই আসছি। এই বেশে তো আর পাম এভিনিউ-এর বৈঠকখানায় ঢোকা যাবে না।
বাড়ি যাওয়ার একমাত্র কারণ ফেলুদার একটু ফিটফট হয়ে নেওয়া। তা ছাড়া হাতেও রং লেগেছিল–জিজ্ঞেস করতে বলল। আলকাতরা—সেটাও ধুয়ে নেওয়া দরকার। আলকাতরাটাও মেক-আপের অংশ কিনা জিজ্ঞেস করাতে কোনও উত্তর দিল না ফেলুদা।
আমরা যখন পাম এভিনিউ রওনা হলাম, তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। পথে লালমোহনবাবু একবার বলেছিলেন, আপনার অমন ব্রিলিয়ান্ট মেক-আপটা মাঠে মারা যাবে। ভাবিনি মশাই— কিন্তু তাতে ফেলুদা কোনও মন্তব্য করেনি।