তাতে আর কী হল, এত বড় স্কলার, হার্বার্টের ডবল এম এ, আমিও তো তাঁর নাম শুনিনি।
কথাটা বোধহয় লালমোহনবাবুকে কিছুটা আশ্বস্ত করল। বললেন, তা যা বলেছেন। এত বড় দুনিয়ায় কটা মানুষকে আর কাটা মানুষ চেনে! আর ভদ্রলোক বোধহয় বেশির ভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন। কাজেই এক্সকিউজ করে দেওয়া যায়-কী বলেন?
আমাদের কথার মাঝখানেই পাম এভিনিউ থেকে ফোন এল। অম্বুজ সেন। একটা বেনামি চিঠি এসেছে ভদ্রলোকের নামে। টেলিফোনে সেটা পড়ে শোনালেন ভদ্রলোক।
আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায় ১০০ টাকার নোটে ২০০০০ টাকা ব্যাগে পুরে প্রিনসেপঘাটের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের থামের ধারে রেখে যাবেন। অম্বর সেনকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাবার এই একমাত্র উপায়। পুলিশ বা গোয়েন্দার সাহায্য নিলে ফল হবে মারাত্মক।
ফেলুদা ফোনে বলল, এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই, মিঃ সেন। আরও চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে। এর মধ্যে আমার কয়েকটা কাজ আছে। আপনাদের দিক থেকে কী করণীয় সেটা আমি কাল দুপুর দুটাের মধ্যে আপনাদের বাড়ি গিয়ে বলে আসব। তবে হ্যাঁ, টাকার ব্যবস্থােটা করে রাখবেন। ওটা খুবই জরুরি।
কিন্তু গোয়েন্দার ব্যাপারে শাসিয়ে রেখেছে যে মশাই, ফেলুদা ফোন রাখার পর লালমোহনবাবু বললেন।
ফেলুদা উত্তরে শুধু বলল, জানি।
রকেটের বেগে ঘটনা এগিয়ে চলেছে। এই টাকাটা না দিয়ে উপায় কী আছে সেটা আমিও ভেবে পেলাম না।
লালমোহনবাবু, কাল আপনার গাড়িটা একটু পাওয়া যাবে কি? প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে থেকে অবশেষে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
এনি টাইম, বললেন জটায়ু। কখন চাই বলুন।
সকলে একবার বেরোিব। সাড়ে নটা নাগাত পেলেই চলবে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমার কাজ হয়ে যাবে। তারপর বিকেল পাঁচটা নাগােত আপনি যদি গাড়িটা নিয়ে চলে আসেন তো খুব ভাল হয়।
ভেরি গুড।
এরপর ফেলুদা আর কোনও কথাই বলল না।
পরদিন লালমোহনবাবুর গাড়িতে করে ফেলুদা বেরোল। একই বেরোল, কাজেই কোথায় গেল কী করল জানার উপায় নেই। বারোটা নাগাত ফিরে আসার পর দেখলাম তার মুখের ভাব বদলে গেছে।
কী ঠিক করলে ফেলুদা৷ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
টাকাটা দিতেই হবে, বলল ফেলুদা। তবে গোয়েন্দা সম্পর্কে হুমকিটা মানা চলবে না।
মানে? তুমি নিজেও থাকবে সেখানে?
ফেলুমিত্তির অত সহজে ঘাবড়াবার লোক নয় রে তোপ্সে।
আমার আমরা? আমরা কোথায় থাকব?
তোরাও থাকিবি কাছাকাছির মধ্যে, কারণ হেলপ দরকার হতে পারে।
আমি তো শুনে থা।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমরা গেলাম পাম এভিনিউ।
অম্বুজবাবু স্বভাবতই বাড়িতে ছিলেন, ফেলুদাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
কাল রাত্তিরে চোখের পাতা এক করতে পারিনি মশাই! দেখতে দেখতে কী যে হয়ে গেল! ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, টাকাটা আপনাদের খসবেই, মিঃ সেন। অম্বরবাবুকে ফিরে পাবার আর কোনও রাস্তা নেই।
তুমি ধরতে পারনি এখনও? রুনা হঠাৎ ঘরের দরজা থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল।
অনেকটা ধরে ফেলেছি, রুনা, বলল ফেলুদা।খুব চেষ্টা করছি। যাতে বাকিটা আজ বিকেলের মধ্যেই ধরতে পারি।
ব্যাস, ঠিক আছে।
রুনাকে ভীষণ নিশ্চিন্ত বলে মনে হল। ফেলুদা ব্যর্থ হবে এটা যেন তার কাছে ভয়ানক একটা দুঃখের ব্যাপার।
তা হলে কী করা উচিত বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করলেন অম্বুজবাবু।
টাকার ব্যবস্থা হয়েছে?
সেটা করে ফেলেছি। বাড়িতে তো অত ক্যাশ থাকে না, তাই আজ সকালেই সমরেশকে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়ে নিয়েছি।
সেই টাকা, এবং যে ব্যাগে করে সেটা দেওয়া হবে—এই দুটো জিনিস আমি একবার দেখতে চাই!
টাকা এবং ব্যাগ এসে গেল। এত টাকা। এর আগে একসঙ্গে দেখেছি কি? মনে তো পড়ে না।
ফেলুদার সামনেই কুড়িটা করে একশো টাকার নোট রাবার ব্যান্ড দিয়ে গোছ করে দশ ভাগে ব্যাগের মধ্যে পুরে দেওয়া হল। তার ফলে ব্যাগের চেহারা হয়ে গেল কচ্ছপের পিঠের মতো।
ভেরি গুড, বলল ফেলুদা। তা হলে আমরা বেরিয়ে পড়ছি পৌনে ছটা নাগাত।
অম্বুজবাবু চমকে উঠলেন।
সে কী, আপনি যাবেন?
অপরাধীকে ধরার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে, মিঃ সেন। আপনি টাকা রেখে আসবেন, আর সে লোক দিব্যি এসে সেটা তুলে নিয়ে চলে যাবে, এ তো হতে দেওয়া যায় না। অম্বরবাবুকে ফেরত পাওয়াটাই বড় কথা সেটা জানি, কিন্তু সেই সঙ্গে এই গুণ্ডাদেরও সাজা হওয়া উচিত নয় কি? না হলে তো তারা এই ধরনের কুকীর্তি করেই চলবে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। সাবধানতা অবলম্বন না করে আমি কখনও কিছু করি না।
তা হলে—
আমি বলছি, আপনি মন দিয়ে শুনুন। আপনি আপনার গাড়িতে করে যাবেন টাকা নিয়ে। নিউ হাওড়া ব্রিজের দিকটা দিয়ে আসবেন। ওদিকটা মোটামুটি নিরিবিলি। গাড়ি প্রিনসেপঘাট থেকে অন্তত দুশো গজ আগে দাঁড় করিয়ে আপনার ড্রাইভারকে বলবেন টাকাটা যথাস্থানে রেখে আসতে। আমি কাছাকাছির মধ্যেই থাকব। কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেটা আমি দেখতে পাব। আমরা মিট করব ঘটনার পর। গে রেস্টোরান্টের সামনে। আপনি টাকা রেখে সোজা ওখানে চলে আসবেন। আমিও তাই করব। অপরাধীকে যদি ধরতে পারি তা হলে তিনিও আমার সঙ্গেই থাকবেন, বলাই বাহুল্য।
অম্বুজবাবুকে মনে হল যিনি তিনি বেশ নার্ভাস বোধ করছেন। সেটা অস্বাভাবিক নয়। টাকার অঙ্কটা তো কম নয়। আর গুণ্ডারা কী করবে না-করবে। কে জানে?