তা জানি বইকী।
দেখেছেন সে চিঠি?
তাও দেখেছি।
আমি অম্বরবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁর জীবনে এমন কোনও ঘটনা ঘটেছিল কি না যার ফলে অন্য কোনও মানুষের সর্বনাশ হতে পারে। উনি বলেছিলেন তেমন কোনও ঘটনা তাঁর জানা নেই। অবিশ্যি আমার বলা উচিত ছিল যে, রিসেন্ট ঘটনা হবার দরকার নেই, অতীতের ঘটনা হলেও চলবে, কেন না প্রতিহিংসার ভাবটা মানুষ অনেক সময়ে অনেক দিন পুষে রাখে। আমি এখন আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি কি এমন কোনও ঘটনার কথা জানেন? দশ-বিশ বছর আগের হলেও চলবে।
ভদ্রমহিলা একটুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে আপনাকে বলি। আপনি দেখুন। এমনি ঘটনার কথাই বলছেন কি না। এটা আমার কাল রাত্তিরে হঠাৎ মনে পড়ে। আমার স্বামীকেও এখনও বলিনি।
কী ঘটনা বলুন তো।
একটা অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপার।
অ্যাক্সিডেন্ট?
অনেক’দিন আগে। তখনও রুনা হয়নি; বোধহয় তার পরের বছরই হল। আমার ভাসুর তখন নিজেই গাড়ি চালাতেন। আমার শ্বশুরের গাড়ি। অস্টিন। উনি শ্যামবাজারের দিকে একজন লোককে চাপা দেন। সে-লোক মারা যায়।
আমরা দুজনেই চুপ। ঘরে থমথমে ভাব। অম্বুজবাবু পাশেই ছিলেন, চাপা গলায় বললেন, আশ্চর্য, এটা আমার মনেই ছিল না।
আর কী মনে পড়ছে? ফেলুদা দুজনকেই প্রশ্নটা করল।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, বললেন অম্বুজবাবু, ক্লার্ক ছিলেন ভদ্রলোক।
নাম মনে পড়ছে?
উঁহু।
স্ত্রী ছিল, আর তিনটি ছেলেমেয়ে, বললেন মিসেস সেন। ছেলেটির বয়স তেরো-চোদ্দো। মেয়ে দুটি আরও ছোট। পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন বিধবার হাতে।
কে, অম্বরবাবু?
হ্যাঁ।
সেই থেকেই দাদা ড্রাইভিং বন্ধ করে দেন, বললেন অম্বুজবাবু।এখন মনে পড়ছে।
হুঁ… ফেলুদা গম্ভীর। তার মানে এখন সে-ছেলের বয়স বছর পাঁচিশ। পরিবারটির যে সর্বনাশ হবে এই ঘটনার ফলে, এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। পাঁচ হাজার টাকা আর কদ্দিন চলে?
এর বেশি আর কিছু মনে পড়ছে না, জানেন, বললেন মিসেস সেন।
আমারও না, বললেন অম্বুজবাবু।
অম্বরবাবু কি ডায়রি রাখতেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কই, সে রকম তো শুনিনি এখনও, বললেন অম্বুজবাবু।
ফেলুদা উঠে পড়ল।
অনেক ধন্যবাদ, মিসেস সেন। আপনি অন্ধকারে একটা আলো দেখিয়েছেন আমাদের, তার জন্য আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ।
আমরা কিন্তু মনেপ্ৰাণে চাইছি যে, আপনি ব্যাপারটার একটা সুরাহা করেন।
কথাটা যে ভদ্রমহিলা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
০৩. অম্বরবাবুর অসুস্থ মা
অম্বরবাবুর অসুস্থ মাকে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না, তাই আমরা আপাতত পাম এভিনিউ-এর পাট শেষ করে সেনেদের অ্যামবাসডরে চলে গেলাম গঙ্গার ধারে। গে রেস্টোরান্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার বিলাসবাবু বললেন, এইখান থেকে স্যার হাঁটতে আরম্ভ করে সোজা দক্ষিণ দিকে গিয়ে ঠিক এক ঘণ্টা বাদে আবার ফিরে আসতেন। একেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়।
আপনি গাড়িতেই বসে থাকতেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কদ্দিন ড্রাইভারি করছেন সেন-বাড়িতে?
নাইন ইয়ারস।
তার মানে অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা আপনি জানেন না?
অ্যাক্সিডেন্ট?
অম্বরবাবু বছর বারো আগে একবার একটি লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মারেন।
সেন সাহেব?
কেন, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
উনি যে কোনওদিন নিজে ড্রাইভ করেছেন সেইটেই জানতুম না।
ওই ঘটনার পরেই ড্রাইভিং ছেড়ে দেন।
তা হবে। ড্রাইভারের তো দোষ দেওয়া যায় না। সব সময়! রাস্তার লোকে যেভাবে চলাফেরা করে, আরও বেশি লোক মরে না কেন সেইটেই তো ভাবি। ড্রাইভারের আর কী দোষ?
অম্বরবাবু যেদিন আর ফিরলেন না, সেদিনের ঘটনাটা একটু বলবেন?
সেদিন উনি আসছেন না দেখে আমি হেস্টিংস পর্যন্ত গিয়ে তল্লাশ করেছিলাম। পথে লোক ধরে ধরে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করছি। গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে রাস্তায় নেমে খুঁজেছি যদি কোথাও পড়ে-টড়ে গিয়ে থাকেন। হার্টটা তেমন মজবুত ছিল না তো।
লোকজন কেমন ছিল রাস্তায়?
সিকালে এদিকটা লোক মন্দ থাকে না। সব হাঁটতে আসে। তবে নিউ হাওড়া ব্রিজের সাইডটায় লোক থাকে না বললেই চলে। স্যার তো। ওদিকেই যেতেন। ফস করে যদি গাড়িতে কটা জোয়ান লোক এসে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে যায়, কেউ টেরও পাবে না।
আমরা গাড়িতে করেই দশ মাইল স্পিডে চালিয়ে হেস্টিংস পর্যন্ত ঘুরে এলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলাম না।
এরপর দুদিন পাম এভিনিউ থেকে কোনও খবর নেই। বিষ্যদবার বিকেলে লালমোহনবাবু এসেই বললেন, ঘটনা এগোল? অম্বর সেন উধাও শুনে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল। বললেন, আপনার একটি কেসও গেজে যেতে দেখলুম না। ধন্যি আপনার লাক!
আপনার গ্রেট স্কলার প্রতিবেশী মৃত্যুঞ্জয় সোমের কী খবর?
দূর দূর! স্কলার না মুণ্ডু!
সে কী মশাই, এর মধ্যে আবার কী হল? সেদিন তা সুপারলেটিভ ছাড়া কথাই বলছিলেন की।
আর বলবেন না মশাই।
কেন, কী হল?
বলতেও লজ্জা করে।
আমার কাছে আবার লজ্জা কী? বলে ফেলুন।
ব্যাপারটা কী জানি না, কিন্তু সেটা যে লালমোহনবাবু চেপে যেতে চাইছেন সেটা বুঝতেই পারছি। এদিকে ফেলুদাও ছাড়বার পাত্র নয়। শেষটায় পীড়াপীড়িতে ভদ্রলোক বলেই ফেললেন।
আরো মশাই, ভাবতে পারেন, ভদ্রলোক প্রদোষ মিত্তিরের নাম শোনেননি। আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গিয়ে একেবারে ভেড়া বনে গেলুম! বলে কিনা-হুইজ প্রদোষ মিত্ৰ?