মোটেই না, বললেন অম্বুজবাবু।
আর আপনার দাদা যেখানে মর্নিং ওয়াকে যেতেন, সেই জায়গাটাও একবার দেখে আসা দরকার।
কোনওই অসুবিধে নেই। আমাদের ড্রাইভার বিলাস আপনাদের গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে আনবে।
ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি আরম্ভ করেছে। তিনটে বড় বড় বুককেস বোঝাই বই, সেইদিকে তার দৃষ্টি।
এ সব বই কার?
সবই দাদার।
নানান বিষয়ে ইস্টারেস্ট আছে দেখছি।
অজ্ঞে হ্যাঁ।
এমনকী গোয়েন্দাগিরি সম্বন্ধেও তো বই আছে।
হ্যাঁ। এক সময় ওটা নিয়েও পড়াশুনা করেছেন।
বিজ্ঞান, ইতিহাস, রান্নার বই, মুদ্রা সংগ্ৰহ, থিয়েটার…
থিয়েটারটা দাদার নেশা বলতে পারেন। আমাদের মাঠে পুজোর সময় স্টেজ বেঁধে নাটক হয়। দাদাই নির্দেশক; ফ্যামিলির সকলেই রংটং মেখে নেমে পড়ে। এমনকী ইনিও। রুশনার দিকে দেখিয়ে দিলেন অম্বুজবাবু। রুনা এখনও সেইভাবেই হাঁ করে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে।
এবারে অম্বরবাবুর কাজের ঘরটা একটু দেখতে পারি?
আসুন আমার সঙ্গে।
অম্বুজবাবু উঠে পড়লেন সোফা থেকে।
বৈঠকখানার পাশে একটা প্যাসেজ, সেইটা পেরিয়ে পিছনের মাঠের দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম আমরা।
পুব দিকের জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘরটাকে আলো করে দিয়েছে। একটা বড় ডেস্ক, তার সামনে একটা রিভলভিং চেয়ার, উলটা দিকে আরও দুটো চেয়ার। জানালার ধারে একটা আরাম-কেদারা। এ ছাড়া টেবিলের পিছন দিকে রয়েছে একটা শেলফ, একটা ক্যাবিনেট আর একটা গোদারেজের আলমারি। তার পাশের দেয়ালে একটা ফোলডিং ব্র্যাকেট থেকে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলছে একটা ছাই রঙের কোট।
ডেসকের উপরটা দেখলে মনে হয় অম্বরবাবু বেশ গোছানো লোক ছিলেন। কাগজপত্ৰ টেলিফোন পেনহালডার পিনকুশন পেপার-ওয়েট চিঠির র্যাক, সব পরিপাটি করে সাজানো। একটা ডেট-ক্যালেন্ডার রয়েছে, তার তারিখটা তিনদিন আগের। ব্যাপারটা আমারও খটকা লেগেছিল, ফেলুদা সেটার দিকে অম্বুজবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ভদ্রলোক বললেন, দাদাকে কয়েক’দিন থেকেই অন্যমনস্ক দেখছিলাম। সচরাচর দাদার এরকম ভুল হয় না কিন্তু।
ফেলুদা খুঁতখুঁতে মানুষ, সে নিজেই শনিবার দোসরাটা বদলে মঙ্গলবার পাঁচই করে দিল।
দেরাজ খুলে দেখতে পারি কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
দেখুন না।
তিনটে দেরাজই পরপর খুলে তার ভিতরের জিনিসপত্র হাতড়ে দেখল ফেলুদা। ওপরের দেরাজ থেকে পাওয়া এক টুকরো কাগজ সম্বন্ধে মনে হল তার একটু কৌতুহল হয়েছে, কারণ সেটা সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।
হিমালয়ান অপটিক্যালস থেকে চশমা করাতেন বুঝি আপনার দাদা?
হ্যাঁ।
একটা ক্যাশমেমো দেখছি। তারিখটা সাতদিন আগের। নতুন চশমা করিয়েছিলেন বুঝি?
কই, না তো! বলে উঠল। রুনা। সে-ও আমাদের পিছন পিছন এসেছে।
তুমি কী করে জানলে, রুনা? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
আমাকে তো দেখায়নি জেঠু!
অম্বুজবাবু একটু হেসে বললেন, দাদা যে কখন কী করছেন তার খবর আমরা সব সময়ে পেতাম না।
আমরা অম্বরবাবুর স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলাম।
আপনাদের এক আত্মীয় এখানে থাকেন বোধ হয়, প্যাসেজে বেরিয়ে এসে বলল ফেলুদা, আপনাদের এখানেই মানুষ হয়েছেন?
কে, সমরেশ? হাঁ, থাকে বইকী।
ফেলুদার অনুরোধে সমরেশকে ডেকে পাঠানো হল। বছর পয়ত্রিশ বয়স, মুখে বসন্তের দাগ, চোখে পুরু চশমা। একটু যেন আড়ষ্টভাব নিয়ে ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন আমাদের দিকে হাত দশেক দূরে।
বসুন, বলল ফেলুদা।
বেশ কিছুটা দূরে একটা চেয়ারে বসলেন সমরেশবাবু।
আপনার পদবিটা কী?
মল্লিক।
কদ্দিন আছেন। এ-বাড়িতে?
বছর পঁচিশ।
কী করেন?
একটা ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন আপিসে কাজ করি।
কোথায়?
ধরমতলায়।
কী নাম কোম্পানির?
কোহিনুর পিকচার্স।
কদ্দিন আছেন। ওখানে?
সাত বাচ্ছর।
তার আগে কী করতে?
এই বাড়ির কাজকর্ম।
হাত দুটোকে ভাঁজ করে হাঁটুর মধ্যে চেপে রেখেছেন ভদ্রলোক-যাকে বলে জবুথবু ভাব।
আপনি অম্বরবাবুর অন্তর্ধনের ব্যাপারে কোনও আলোকপাত করতে পারেন?
সমরেশবাবু চুপ। ফেলুদা বলল, তিনি একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন জানেন?
জানি।
আপনার ঘর কি এ-বাড়ির একতলাতে?
হ্যাঁ।
অম্বরবাবুর কাছে বাইরের লোকজন দেখা করতে আসত?
তা আসত, মাঝে-মাঝে।
সম্প্রতি এমন কোনও লোককে আসতে দেখেছেন, যাকে আগে দেখেননি?
সেটা লক্ষ করিনি। তবে,–
তবে কী?
এই পাড়ায় কিছু ছেলেকে দেখেছি, যাদের আগে দেখিনি।
কোথায়?
মোড়ের মাথায়।
কী করত তারা?
মনে হত এই বাড়ির দিকে চোখ রাখছে।
বয়স কীরকম তাদের?
বিশ থেকে পাঁচিশের মধ্যে বলে মনে হয়।
কজন ছেলে?
চারজন।
ফেলুদা একটুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আপনি আসতে পারেন।
এইসব কথা থেকে ফেলুদা কোনও কু পেল। কিনা জানি না। যেটাতে মনে হয়। সত্যি করে কাজ হল, সেটা হল অম্বুজবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তায়।
রীতিমতো সুন্দরী মহিলা, তার উপর যাকে বলে ব্রাইট। বয়স চল্লিশের উপর হলেও দেখে বোঝার জো নেই। দোতলার একটা ছোট বৈঠকখানায় বসে কথা হল।
ফেলুদা প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল ভদ্রমহিলাকে বিব্রত করার জন্য। তাতে কী হয়েছে, বললেন মিসেস অম্বুজ সেন, গোয়েন্দাকে যে এভাবে জেরা করতে হয় সে তো ফেলুদার গল্প পড়েই জেনেছি। খুব ভাল লাগে পড়তে গোয়েন্দার কাহিনী।
তা হলে তো ভালই হল, বলল ফেলুদা। আমার প্রধান মুশকিলটা কোথায় হচ্ছে বলি। অম্বরবাবু একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন জানেন বোধহয়।