ফেলুদা একটু কিন্তু-কিন্তু ভাব করছে দেখে ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আমি শুধু ব্যাপারটা জানিয়ে গেলাম। হতে পারে এটা একটা প্রাকটিক্যাল জোক ছাড়া আর কিছুই না; তবে কী জানেন, এ ধরনের রসিকতার টারগেট বিখ্যাত ব্যক্তিদের মাঝে মাঝে হতে হয় ঠিকই, কিন্তু আমি তো আর তেমন কেউ-কেটা নই, তাই…
ফেলুদা বললে, বুঝতেই পারছেন, এ হুমকি যদি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হয় তা হলে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। যাই হাক-আপাতত এই চিঠিটা আমি রাখতে পারি তো?
নিশ্চয়ই। ওটা তো আপনাকে দেবার জন্যেই আনা।
এমন একটা হুমকি-চিঠি নিয়ে অম্বর সেনের ফেলুদার কাছে আসাটা একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল, পরদিন সকালে পাম এভিনিউ থেকে যে ফোনটা এল, তাতে সমস্ত ব্যাপারটা একটা অন্য চেহারা নিল।
বসবার ঘর থেকে ফেলুদার ঘরে কলটা ট্রানসফার করে দিয়ে কান লাগিয়ে যা শুনলাম তা হল এই–
কে, মিস্টার মিত্তির?
অজ্ঞে হ্যাঁ!
আমার নাম অম্বুজ সেন। কাল আমার দাদা বোধহয় আপনার ওখানে গেসলেন একটা হুমকি-চিঠির ব্যাপারে?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
ওয়েল, হি ইজ মিসিং।
মানে?
দাদাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
পাওয়া যাচ্ছে না?
না! দাদা রোজ ভোরে গাড়িতে করে বেরোন; গঙ্গার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তারপর মাইল দুয়েক হাঁটেন! আজও গেসলেন, কিন্তু আজ আর ফেরেননি।
সে কী!
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে এক ঘণ্টা ওয়েট করার পর। ও তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও দাদার দেখা পায়নি।
পুলিশে জানাননি?
সেখানে একটা গোলমাল আছে মিঃ মিত্তির। আমার মার বয়স আশি, শরীরও ভাল নেই। ওঁকে দাদার ব্যাপারটা নিয়ে এখনও কিছুই জানাইনি। পুলিশ এলেই কিন্তু ব্যাপারটা আর চাপা থাকবে না। তখন ওঁকে সামলানো মুশকিল হবে। কাজেই আমাদের ইচ্ছা কেসটা আপনিই হ্যান্ডল করুন। আপনার উপর আমাদের পুরো ভরসা আছে। অবশ্য আপনার উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমরা দেব।
আমি তা হলে একবার আপনাদের ওখানে আসছি। অসুবিধা হবে না তো?
মোটেই না! আপনি এখনই চলে আসুন। আমাদের বাড়ির নম্বরটা জানেন তো?
ফাইভ বাই ওয়ান পাম এভিনিউ তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
০২. সাহেবি ধাঁচের গাড়িবারান্দাওয়ালা দোতলা ছড়ানো বাড়ি
সাহেবি ধাঁচের গাড়িবারান্দাওয়ালা দোতলা ছড়ানো বাড়ি, সামনে একটা ছোট বাগান, পিছনেও সবুজ দেখে মনে হল বোধহয় টেনিস কোর্ট জাতীয় কিছু আছে। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে অম্বরবাবুর বাবার নাম, নামের পরে অনেকগুলো ইংরিজি অক্ষর, কমা, ফুলস্টপ। সব শেষে ব্র্যাকেটের মধ্যে এডিন কথাটা দেখে বুঝলাম ভদ্রলোককে স্কটল্যান্ড যেতে হয়েছিল ডাক্তারি পড়তে।
যিনি আমাদের ট্যাক্সির শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এলেন তাঁর সঙ্গে আম্বরবাবুর আদল আছে ঠিকই, কিন্তু ইনি বেঁটে, মোটা আর কালো। অর্থাৎ মুখের মিল বাদ দিলে ইনি অম্বরবাবুর ঠিক উলটা।
আমাদের দেখে ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটে উঠলেও, দুশ্চিন্তার ফলে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল।
আসুন ভিতরে।
শ্বেতপাথরের মেঝেওয়ালা ল্যান্ডিং পেরিয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলাম। এখানেও মাৰ্বল, তার উপর কাৰ্পেট, আর তার উপর দামি দামি ফারনিচার। যে সোফায় বসলাম, সেটার গদি এত নরম যে, আমার ভারেই প্ৰায় ছ। ইঞ্চি বসে গেল!
রুনা, এসো।
একটি ফ্রক-পরা মেয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। অম্বুজবাবু ডাকতেই সে গুটি গুটি ঘরের ভিতরে এগিয়ে এল।
ইনি কে জান? জিজ্ঞেস করলেন অম্বুজবাবু!
ফেলুদা, চাপা গলায় উত্তর এল।
আর ইনি?
তোপ্সে।
বাঃ, তুমি তো আমাদের দুজনকেই চেনো দেখছি, বলল ফেলুদা।
জটায়ু কোথায়? জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। বোঝা গেল সে এই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে না দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছে।
তিনি তো আসেননি, বলল ফেলুদা। তবে তাঁকে এক’দিন নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।
তোপ্সে এত মিথ্যে কথা বলে কেন?
এই রে!—আমার সম্বন্ধে হঠাৎ এমন বদনাম কেন?
মিথ্যে মানে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
একটা বইয়ে লিখেছে ফেলুদা ওর মাসতুতো ভাই, আরেকটায় লিখেছে জ্যাঠতুতো ভাই। মিথ্যেই তো।
ফেলুদাই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। বলল, ওহো–প্রথমে মাসতুতো ভাই লিখেছিল বটে, তখন ও গপপের মতো বানিয়ে লিখতে চেষ্টা করছিল। আমি ধমক দিতে তারপর সত্যি কথাটা লিখতে শুরু করল। আসলে জ্যাঠতুতো ভাইটাই ঠিক।
আপনার সব অ্যাডভেঞ্চার ওর পড়া, বললেন অম্বুজ সেন।
জেঠুকে খুঁজে বার করে দিতে পারবে তুমি? ফেলুদার দিকে সটান তাকিয়ে প্রশ্ন করল রুনা।
চেষ্টা করতে হবে। বলল ফেলুদা; তুমি যদি কোনও কু জোগাড় করে দিতে পারো তা হলে তো কথাই নেই!
ক্লু?
ক্লু জানি তো?
জানি।
আছে তোমার কাছে কোনও ক্লু, যাতে আমরা চট করে বের করে দিতে পারি তোমার জেঠুকে?
ক্লু তো তুমি বার করবে। তুমি তো ডিটেকটিভ।
ঠিক বলেছ। খুব চালাক মেয়ে তুমি। কী নাম তোমার? একটা নাম তো জানি, অন্যটা কী?
ভাল নাম ঝর্না।
ফেলুদা অম্বুজবাবুর দিকে ফিরল।
দেখুন, আপনাদের দিক থেকে কতকগুলো ব্যাপারে সাহায্য না পেলে কিন্তু আমার পক্ষে এগোনো মুশকিল হবে।
কী সাহায্য বলুন।
প্রথমত, আপনাদের সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। আপনার দাদার সঙ্গে আমার মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ। তাঁকে আমার আরেকটু ভাল করে চিনতে হবে। তাঁর কাজের ঘরটাও একবার দেখা দরকার। এমনকী, দরকার হলে তাঁর জিনিসপত্র একটু ঘেঁটে দেখতে হতে পারে। আশা করি আপত্তি হবে না।